শিশুদের আঁকার খাতায় হিংসায় বিধ্বস্ত পৃথিবীর ছবি। যাদের খাতা ভরে ওঠার কথা ছিল রঙিন স্বপ্নে, তাদের হাতেই ফুটে উঠছে বারুদ-আগুনের ছবি। পৃথিবীর গভীর অসুখের কথাই যেন বলছে সেইসব আঁকার খাতা।
যে আকাশে কেবল যুদ্ধবিমানই ওড়ে, সেই আকাশের নিচে বসে কি আর তারার ছবি আঁকা যায়! সে দুনিয়ায় আঁকার খাতাতেও অন্য সব রং ছাপিয়ে জেগে ওঠে অন্ধকার। যে অন্ধকারের বুকে জমে আছে হিংসা আর হানাহানির গল্প। আর তেমনই গল্প সম্প্রতি শোনাল জনকয়েক খুদে।
গল্প শোনানোর বদলে বলা যেতে পারে, সে গল্প চোখের সামনে তুলে ধরেছে ওই খুদেরা। আসলে এক বসে আঁকার আসরেই সে গল্পের খতিয়ান দিয়েছে তারা। মনে পড়তে পারে, ‘বসে আঁকো’ গানে এমনই কিছু খুদের কথা ছিল। যাদের আঁকার খাতা জুড়ে ছিল ফুল, নদী, প্রজাপতি কিংবা মিকি মাউসের সুন্দর ছবি। সে গানেই কবীর সুমন কটাক্ষের সুরে বলেছিলেন, “এঁকো না কখনও স্বদেশের মুখ/ তোবড়ানো গাল, ভেঙে যাওয়া বুক”। আসলে এই না আঁকার নির্দেশে লুকিয়ে ছিল অনুযোগ। নিজের চারপাশকে, নিজের দুনিয়াকে ছুঁয়ে না দেখার কটাক্ষ। জীবনের ক্ষত লুকিয়ে রাখা দেখতে দেখতে ক্লান্ত গান তাই একসময় অনুরোধ করে বসেছিল, যাতে কেউ, কখনও ‘অন্য ছবি’-ও আঁকে। এই খুদেরা সেই অন্য ছবিই এঁকেছে আসলে। আর সেই অন্য ছবির কর্কশ সত্যিকে ছুঁয়ে দেখতে গিয়েই আমূল কেঁপে উঠেছেন সে ছবির দর্শকেরা। কেননা সে ছবি জুড়ে আছে ঘরে পুলিশের আচমকা হামলা, শিশুদের দিকে তাক করা বন্দুক, কিংবা স্কুলে যেতে না-পারা না-খেতে পাওয়া শিশুদের গল্প। যে পৃথিবী গান কবিতা দিয়ে জীবনের ক্ষত ঢেকে রাখে কেবল, এত সত্যি গল্প সহ্য করা কি তার পক্ষে সম্ভব?
আরও শুনুন: ৬০ শতাংশ খুদে ভুগছে একটাই অসুখে! সাবধান হতে হবে কোন বিষয়ে?
বাকি পৃথিবীর সেই শৌখিন শিল্পের দিকে এমনই আঘাত ছুড়ে দিয়েছে এই খুদেরা। রিও ডি জেনেইরোর উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দা তারা। যাদের রোজকার জীবন কাটে হিংসার আঁচে পুড়তে পুড়তে। সেখানে ড্রাগ ব্যবসায়ীদের ধরতে নিত্যদিন পুলিশের হানা চলে। আর ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে আম মানুষেরা। চোর পুলিশ খেলায় কখনও বুলেট মাথা ফুঁড়ে দেয় তাদের, কখনও আবর্জনার স্তূপে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাতে হয়, কখনও তল্লাশি চালানোর নামে বাড়িঘর তছনছ করে দেয় পুলিশ। শুধু ২০১৯ সালেই পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ৪২ জন মানুষের। সেখানকার ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সি শিশুদের যখন লিখতে বা আঁকতে বলা হয়েছিল, তখন সেই জীবনটার কথাই তুলে এনেছে যারা। কেউ লিখেছে ১৪ বছরের মার্কাসের মৃত্যুর কথা, যে স্কুলে যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, আর পিছন থেকে আসা পুলিশের গুলিতে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। সে ঘটনার বিচার মেলেনি, যেমন তাদের রোজকার বেঁচে থাকার সংকটেরও কোনও সুরাহা হয় না।
এই সমস্ত সত্যি গল্পেরাই ঠাঁই পেয়েছে দু’মলাটের মধ্যে। যে বইয়ের নাম, ‘আমার স্কুলে থাকার কথা ছিল’। স্কুলে না যেতে পারা, গুলি-বোমায় বিধ্বস্ত দিনগুলিই সেই বইয়ে দগদগে হয়ে আছে। তার মধ্যেই কেউ অবশ্য আপেল গাছ, মেঘ, আর রামধনুর ছবি আঁকতেও ভোলেনি। যেমন দিনে সত্যি সত্যি স্কুলে যাওয়া যায়। কারণ, অন্ধকারে বেঁচে থাকা সেই শিশুরাও জানে, গল্পের শেষে আসলে আলো ফুটে ওঠারই কথা। আর আলো যতক্ষণ না ফুটে ওঠে, ততক্ষণ গল্পটা শেষ হয়নি, এই আশাটুকুই করে যেতে হয়।