ভোটপ্রচারে যে নেতারা নিজেদের গুণগান করবেন, তা তো স্বাভাবিক। নিজের দলের সম্পর্কেও ভালো ভালো কথা বলতে পারেন। তা নিয়ে আশ্চর্য বা চিন্তিত হওয়ার মতো আদতে কিছু নেই। তবে যদি শোনা যায় যে, একজন নেতা বা নেত্রী এমন একটা কথা বলছেন, যা যথেষ্ট বিতর্কিত, তখনই মূল বিপত্তি। এমন হতেও পারে যে, তিনি আদতে সে কথা বলেননি। তাঁর গলা নকল করে তাঁর মুখে কোনও একটি বিতর্কিত কথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা ঘুরিয়ে দিতে পারে ভোটের হাওয়া। কেন দানা বাঁধছে এই আশঙ্কা?
নির্বাচনের মরশুম। এ সময় কত ঘটনা যে ঘটিতে পারে, তার ইয়ত্তা নেই। সাধারণ মানুষের বরাবরের অভিযোগ যে, ভোট এলে তবেই নেতা-মন্ত্রীরা একটু মানুষের কাছে পৌঁছন। তাঁদের কথা শোনেন। দুটো কথা মুখ ফুটে বলেনও। হয়তো নেহাতই প্রতিশ্রুতি, রাখা হবে কি হবে না, তা কেউ জানে না। তো প্রযুক্তির কল্যাণে আজকাল ফোনেও নেতাদের কথা শোনা যায়। ভোটপ্রচারের ধরনধারণ ইদানীং বিলকুল বদলে গিয়েছে। ভোটের আবহে, এরকম ফোন যদি আসে, তাহলে কিন্তু একটু চিন্তারই বিষয়। নেতারা ফোন করছেন বলে চিন্তা নয়, চিন্তা তাঁরা কী বলছেন তা নিয়ে।
এখন ভোটপ্রচারে যে নেতারা নিজেদের গুণগান করবেন, তা তো স্বাভাবিক। নিজের দলের সম্পর্কেও ভালো ভালো কথা বলতে পারেন। তা নিয়ে আশ্চর্য বা চিন্তিত হওয়ার মতো আদতে কিছু নেই। তবে যদি শোনা যায় যে, একজন নেতা বা নেত্রী এমন একটা কথা বলছেন, যা যথেষ্ট বিতর্কিত, তখনই মূল বিপত্তি। তা যে তিনি বলতে পারেন না এমন নয়। চেনা গলা হলে তা শুনে মিলিয়েও নেওয়া যায়। নেতা যদি সত্যিই সে কথা বলেন, তাহলে ঝামেলা মিটেই গেল। তবে, এমন হতেও পারে যে, তিনি আদতে সে কথা বলেননি। তাঁর গলা নকল করে তাঁর মুখে কোনও একটি বিতর্কিত কথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। যা ঘুরিয়ে দিতে পারে ভোটের হাওয়া। এই সম্ভাবনা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অর্থাৎ এআই। অনেকে মনে করছেন, ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহারে এমনটা করা সম্ভব। আর তা মূলত ভুল বা ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে দেবে। প্রযুক্তি এতটাই উন্নত যে, কণ্ঠস্বরে আসল-নকল চেনা দায়। ফলত নেতা একটি বিতর্কিত মন্তব্য করছেন, নাকি করছেন না, তা চট করে ধরা সহজ নয়। এই আশঙ্কা শুধুমাত্র যে আমাদের দেশে, তা নয়। গোটা বিশ্ব জুড়েই ভোটের আবহে তা ক্রমশ বাড়ছে। খোদ বাইডেনের কণ্ঠ নকল করে এমন তথ্য প্রচারিত হয়েছিল, যা তিনি বলেননি।
এদিকে প্রযুক্তিকে তো বিদায় জানানোর কোনও উপায় নেই, বরং তাকে অভ্যর্থনাই করতে হবে। একদিক থেকে এই প্রযুক্তির ব্যবহারে ভোটের প্রচার আরও সহজ হতে পারে। ভাষাগত যে ব্যবধান আছে, তা পেরিয়ে যেতে পারেন নেতামন্ত্রীরা। তবে, তা যদি মন্দ কাজে লাগানো হয় তাহলেই মুশকিল। ভোটের মুখে মতামত গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। সেই সময় কোনও নেতা বা নেত্রীর মুখ বা কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে যদি ভুয়ো ন্যারেটিভ নির্মাণ করে ছড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে মুশকিল। এআই-এর ব্যবহার যেভাবে বাড়ছে, তাতে এই ধরনের ঘটনা অসম্ভব বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। বরং একে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই দেখা হচ্ছে গোটা বিশ্বে। আর তাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে মানুষের কিছু যাচাই না করে দেখার বর্তমান অভ্যাস। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় রিলের পর রিল দেখি। ঠিক যেন হাতে গরম খাবার পেলে গপাগপ খাওয়া শুরু সেরকমই। সেক্ষেত্রে আর খতিয়ে দেখা হয় না খাবারটি কোথা থেকে এল, কোন তেলে রাঁধা হল ইত্যাদি তথ্য। এই ভিডিওগুলির ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। মানুষের মনোসংযোগের আয়ু কমছে। ফলত চোখের সামনে যা দেখা হচ্ছে, তাই-ই আপাত ভাবে বিশ্বাস করে নেওয়া হচ্ছে। তা সত্যি না মিথ্যা, আদৌ তা হতে পারে কিনা, এরকম চিন্তা আর কাজ করছে না। সদ্য মেট্রোর মধ্যে দুই তরুণীর একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে, যা ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহারেই নির্মিত বলে বলে অনেকে মনেকরছেন। কেননা আশেপাশের মানুষের ব্যবহার ঘটনার সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। সেরকমই বিতর্কিত ভিডিও ক্ষেত্রেও আমরা আগাপাশতলা খতিয়ে দেখি না। বিপদ মূলত সেখানেই।
তবে প্রযুক্তিকে দোষারোপ করা বৃথা। দরকার সচেতনতা এবং নিয়ন্ত্রণের। ভারতবর্ষের বর্তমান আইনে এই ধরনের কাজ রোখার বিধি আছে। তা ছাড়া যে ন্যায়সঙ্ঘিতা চালু হচ্ছে, তাতে দেশের পক্ষে ক্ষতিকর যে কোনও কাজ আরও কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কথাই ভাবা হছে। তবে সবার আগে দরকার নিজেদের বিবেচনা বোধ। যা শুনছি, যা দেখছি, তা সত্যি তো? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে কাজ না করলে প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার বাড়বে বই কমবে না। এদিকে নিজের ভোটটি যে মূল্যবান তা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তাই ভুলের ফাঁদ পা দেওয়ার আগে সতর্ক থাকাই সবথেকে জরুরি।