রাষ্ট্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে এক অন্যরকম, না-রাজনীতির পথ দেখাতে চেয়েছিলেন ইরম শর্মিলা চানু। চিৎকৃত প্রতিবাদ থেকে দূরে লিখেছিলেন এই অভিনব প্রতিবাদের বয়ান। কিন্তু রাষ্ট্রের উপেক্ষার চালে কি পথ ভুলই হয়ে গেল শেষমেশ? জন্মদিনে মণিপুরের মেয়েকে খোলা চিঠি লিখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
ইরম শর্মিলা চানু,
আপনি যেদিন প্রথমবার অনশনে বসেছিলেন, রাষ্ট্রের উপর অনেকখানি ভরসা ছিল আপনার। আপনি মনে করেছিলেন, রাষ্ট্র তো আসলে মায়েরই মতো। কোনও সন্তান অতখানি প্রিয় নাও হতে পারে, তবুও সে না খেয়ে থাকলে মায়ের ঠিক কষ্ট হয়। আপনিও তাই মনে মনে নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলে ভারতমাতা একদিন ঠিক আপনার দিকে তাকাবেন। কিংবা আপনাদের দিকে। নিজের যে জন্মভূমিতে আপনাদের ধর্ষিত হওয়ার কিংবা গুলি খাওয়ার ভয় নিয়ে রোজ বাঁচতে হত, সেই ভয় থেকে মুক্তি পেতে আপনি বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু চিৎকার করে নয়। আপনি জানতেন, ক্ষমতা সব চিৎকারকেই গলা টিপে মারে। তাই সরাসরি রাজনীতির পথেও সেদিন হাঁটতে চাননি আপনি। পাছে ‘কোন দল তুমি, কোন দল?’ এই প্রশ্নের গর্জন মূল প্রশ্নকেই ঢেকে ফেলে। আপনি খুঁজতে চেয়েছিলেন অন্য কোনও পথ, যে ফাঁক দিয়ে গোটা দেশের কানে পৌঁছতে পারে আপনাদের স্বর।
আসলে পথ খোঁজা ছাড়া আর কী-ই বা উপায় ছিল আপনার, শর্মিলা চানু? আপনি যে বছর জন্মেছিলেন, সেই বছরই আপনার জন্মভূমি মণিপুরে লাগু হয়েছিল ‘আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট’, বা আফস্পা। রাতারাতি আপনাদের সকলের গায়ে লেগে গিয়েছিল ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’-র তকমা। বড় হওয়ার প্রতিটি মুহূর্তে সেই সন্দেহের নজর এসে বিঁধছিল আপনাকেও। তার হাত থেকে আপনি রেহাই চেয়েছিলেন। আর সেই চাওয়া পূরণ করার ভারও আপনি তুলে নিয়েছিলেন নিজের হাতেই। আপনি তো সেই মণিপুরের মেয়ে, যেখানে এখনও মাতৃতন্ত্র কায়েম হয়ে আছে। মহাভারতের মণিপুরের অবস্থান নিয়ে ইতিহাস ভূগোল যাই বলুক, আমাদের ভাবতে ভালো লাগে যে মণিপুরনন্দিনী চিত্রাঙ্গদার মতোই নিজের লড়াই নিজে লড়া-ই আপনাদের অভ্যাস। মহাভারতে তো কেবল চিত্রাঙ্গদাই ছিলেন না, ছিলেন দ্রৌপদীও। যিনি অপমানের প্রতিশোধ না হওয়া পর্যন্ত চুল বাঁধতে অস্বীকার করেছিলেন। শর্মিলা চানু, অনশনের সঙ্গে সঙ্গে আপনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, চুল বাঁধবেন না, দেখবেন না আয়নাও। আসলে সব পূর্বনারী আর উত্তরনারীদের লড়াই কোথাও না কোথাও এক সুতোয় গাঁথা হয়ে যায়, বলুন? ঠিক যেমনটা হয়েছিল আপনার অনশনের বছরগুলোতেও। আপনি যে বছর অনশন শুরু করেন, সেই ২০০০ সালেই বিতর্কিত আফস্পা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য মঞ্চে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সাবিত্রী হেইসনাম। কী আশ্চর্য জানেন, রাষ্ট্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গলা তুলতে যে গল্পের আশ্রয় নিয়েছিলেন মণিপুরের এই খ্যাতনামা শিল্পী, সেটির নামও ‘দ্রৌপদী’। জোতদারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার অপরাধে যে দ্রৌপদী গণধর্ষিতা হন।
সেদিন না সাবিত্রী, না আপনি, কেউই জানতেন না, ২০০৪ সালের ১১ জুলাই আপনাদের জন্মভূমির মাটিতে পড়ে থাকবে থাংজাম মনোরমার গণধর্ষিতা মৃতদেহ। তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহ প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় আধাসামরিক ইউনিট, ১৭ অসম রাইফেলসকে। কারণ সেই প্রশ্নটা গোটা দেশের সামনে ছুড়ে দিয়েছিলেন আপনারই মতো মণিপুরের মেয়েরা। মনোরমার মৃত্যুর প্রতিবাদে মণিপুরের কাংলা দুর্গে অসম রাইফেলসের সদর দপ্তরের সামনে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সেখানকার জননীরা। রাষ্ট্রের রাজনীতির বিরুদ্ধে এক অন্যরকম, না-রাজনীতির পথ দেখিয়েছিলেন আপনারা।
কিন্তু, তারপর? আপনার প্রতিবাদ তার আগে শুরু হয়েছিল, সেদিনও জারি ছিল, জারি ছিল তার পরের আরও দিনের পর দিন। এমনভাবেই আপনার জীবন থেকে ঝরে গিয়েছে ষোলটা বছর। সেই ষোল বছরে আপনার জীবনে প্রেম ছিল না। পরিবার ছিল না। মা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন মেয়ের অনশনে আফস্পা উঠলে পর তবেই তিনি মেয়ের মুখ দেখবেন। নিজস্ব রাজনীতি নিয়ে আপনি থেকে গিয়েছিলেন শর্মিলা চানু, একেবারে একা। হ্যাঁ, একাই। ভিড়ে শামিল আমরা আপনাকে মনে রাখিনি। আপনার ষোলো বছরের অনশন আমাদের দৈনন্দিনে কোনও ছাপ ফেলেনি। আপনার নিজের মাটিই বা কতটুকু মনে রেখেছে আপনাকে? তাহলে কি আর রাজনীতিতে নাম লেখানোর পর মাত্র ৯০টি ভোট পেয়ে প্রাচীন ইতিহাস হয়ে যেতে হয় আপনাকে? হয়তো সেটাই আপনার প্রস্থানের চিহ্ন। অনশনের মতো রাজনৈতিক হাতিয়ারকে দলীয় বা ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার না করেও যে সর্বজনীন করে তোলা যায়, আপনি দেখিয়েছিলেন। সেখান থেকে দলীয় রাজনীতিতে যোগ হয়তো আপনার প্রতিবাদের সাধনাকেই খানিক লঘু করে দিয়েছে। সে কথা সম্ভবত আপনি নিজেও জানতেন। তীব্র অভিমানে প্রশ্ন রেখেছিলেন, সকলে কি তবে আমার মৃত্যুই চাইছিল?
এর উত্তর কারও কাছে নেই। তবে হ্যাঁ, প্রতিবাদের যে ইতিহাস আপনি হয়ে উঠেছিলেন, তার শেষ অধ্যায়টিও লেখা হয়েছে আপনার হাতেই। তবু এই প্রতিবাদহীন পৃথিবীতে আপনি স্বতন্ত্র হয়েই থেকে যাবেন। রাষ্ট্রীয় উপেক্ষা আপনার জেদকেই বশ করে ফেলেছে। দেড় দশকে নিভে গিয়েছে পুরনো মশাল। কিন্তু সত্যি কি তাই? আপনি জানেন না, ২০১৬ সালে অনশন ভাঙার বছর কয়েক আগে, কলকাতায় এক নাট্যপ্রযোজনায় জুড়ে গিয়েছিলেন আপনি। রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘নটীর পূজা’ নাটকে প্রতিবাদী শ্রীমতীর মৃত্যু হয়েছিল রাজশক্তির হাতে, কিন্তু এ নাটকে সে বেঁচে ছিল আপনার আদলে। গোপন হাসি হেসে ক্ষমতা বলেছিল তাকে উপেক্ষা করতে। তাহলেই লোকে তাকে ভুলে যাবে। কিন্তু মারলে যে ও অমর হয়ে যাবে। কিন্তু কে বলতে পারে, রাষ্ট্রীয় উপেক্ষা কিংবা ব্যক্তিগত বিচ্যুতির পরেও, আপনি হয়তো থেকে যাবেন দলীয় রাজনীতির বাইরেও এক প্রতিবাদের সাধনা হয়ে। একজন শর্মিলা হয়তো শেষমেশ নিজের জেদ রক্ষা করতে পারেননি। তবে পুরনো আগুন থেকে যে নতুন কেউ আগুন জ্বালিয়ে নেবে না, তা কে বলতে পারে! আর যদি তা হয় সেটাই হবে আপনার সবথেকে বড় রাজনৈতিক সাফল্য। আমরা তেমন ভোরেরই অপেক্ষায় থাকি।