‘পরিবর্তনই একমাত্র সত্য’, এই বাণী মেনে বিগত বছর কয়েক ধরে রাজনীতির ময়দানে দলবদল করাই যেন ধ্রুব সত্যি হয়ে উঠেছে। ‘বদল’ শব্দখানার মধ্যেই যেখানে ঘাপটি মেরে আছে ‘দল’, সেখানে দলে দলে বদল যে হবেই, তা তো খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। দলবদল খেলার মাঠে হয়, হয় রাজনীতির ময়দানেও। কিন্তু সেই দলবদল নিয়ে দলের বাইরে থাকা এই আমজনতার কী মত?
“বদল তোমার হয়, বদল আমারও
বদলাও কে কতটা বদলাতে পারো”…
কিন্তু সে বদল কি সবসময়ে একইরকম কাঙ্ক্ষিত? ‘বদল’ শব্দখানার মধ্যেই যেখানে ঘাপটি মেরে আছে ‘দল’, সেখানে দলে দলে বদল যে হবেই, তা তো খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেই দলবদল নিয়ে দলের বাইরে থাকা এই আমজনতার কী মত? দলবদল খেলার মাঠে হয়, হয় রাজনীতির ময়দানেও। আমরা যদিও কোনও দলাদলিরই শরিক হতে পারি না, ঢালতলোয়ারহীন দর্শক হয়েই থাকি। কিন্তু হাততালি বা দুয়ো দেওয়ার অধিকার তো দর্শকেরও আছে। সেখান থেকে দাঁড়িয়ে দুই দলবদলের ঘটনাকে কি একই চোখে দেখা হয়? ‘পরিবর্তনই একমাত্র সত্য’, এই বাণী মেনে বিগত বছর কয়েক ধরে রাজনীতির ময়দানে দলবদল করাই যেন ধ্রুব সত্যি হয়ে উঠেছে। কিন্তু আইপিএল-এ যে পরিবর্তন দেখে আমরা উল্লসিত হই, রাজনীতিতে মুড়িমুড়কির মতো দলবদল ঘটলে সেই আমাদের কাছেই তা অনেক সময় হয়ে দাঁড়ায় হাসির খোরাক।
আরও শুনুন:
এমনিতে টিমগেমের জগতে দল বদলানো নতুন কথা নয়। কখনও বেশি টাকার আকর্ষণ, কখনও অন্যান্য সুযোগসুবিধা, কখনও ভালো পজিশনে খেলার সুযোগ পাওয়া- এমন নানা কারণেই মরশুম শুরুর আগে খেলোয়াড়েরা দল বদলে ফেলেন। ফুটবলের দুই বড় ক্লাবের মধ্যে কোনটিকে বেছে নেবে এক নামী খেলোয়াড়, তা নিয়ে দড়ি টানাটানির কাহিনি লিখেছিলেন মতি নন্দী। ‘দলবদলের আগে’ নামের সে উপন্যাসে দলবদল আটকানোর জন্য খেলোয়াড়কে হুমকি দেওয়া থেকে আটকে রাখা, কোনও কিছুই বাদ যায়নি। আসলে খেলার মাঠ যাঁরা চেনেন, তাঁরা এ কথাও জানেন যে, দলবদল সেখানে সহজাত প্রবৃত্তি। আগে ফুটবলে সিজন শুরুর আগে ভালো খেলোয়াড়দের দলে টানার জন্য রেষারেষি চলত বড় দলগুলিতে। এখন শুধু ফুটবল নয়, আইপিএল শুরুর পরে ক্রিকেটের দুনিয়াতেও একইভাবে ভাগ বসিয়েছে দলবদলের অভ্যাস। যেমন দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ছেড়ে কলকাতা নাইট রাইডার্সে খেলতে এসেছেন গৌতম গম্ভীর। কিংবা ডেকান ছেড়ে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে চলে গিয়েছেন রোহিত শর্মা। সম্প্রতিই গুজরাত টাইটান্স থেকে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে যেতে দেখা গিয়েছে হার্দিক পান্ডিয়াকে। এমনকি চেন্নাইয়ের দল সাসপেনশনের মুখে পড়ায় খোদ মহেন্দ্র সিং ধোনি দল বদলে পুনে সুপারজায়ান্টে খেলতে আসেন। কিন্তু কথা হল, এই সমস্ত দলবদলকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছেন খেলার মাঠের দর্শকেরা। আইপিএল-এর নিলামের সময় কোন খেলোয়াড় কোন দলে থাকলেন বা কে কোন নতুন দলে গেলেন, তা দেখতে মুখিয়ে থাকেন তাঁরাও। তবে সেই একই ঘটনা যখন রাজনীতির ময়দানে ঘটতে দেখা যাচ্ছে, সেখানে কিন্তু দর্শকেরা কখনও হতাশ হচ্ছেন, কখনও বা বিরক্ত। সম্প্রতি এই দলবদলের প্রসঙ্গেই পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘ছোটবেলায় আমরাও মানুষকে দলবদল করতে দেখেছি। তার মধ্যে একটা সময়জ্ঞান বা সভ্যতার চিহ্ন থাকত। কিন্তু এখন বিষয়টা ইনস্ট্যান্ট নুডলস্-এর মতো হয়ে গিয়েছে! ইনস্ট্যান্ট দলবদল।” এই দলবদলের মধ্যে কোনও ভাবনা বা চিন্তা বা কোনও আদর্শের ছোঁয়া নেই বলেই রাজনীতি ব্যাপারটাই প্রায় সার্কাসে রূপান্তরিত হয়েছে, এমনটাই ছিল তাঁর মত।
আরও শুনুন:
সোশাল মিডিয়ায় লকডাউন! অ্যাকাউন্ট নাকি নিজের ইমেজ হারাবার ভয়েই হাহাকার?
আসলে, একসময় রাজনীতির দুনিয়ায় আদর্শকে আঁকড়ে ধরে থাকতেন অনেক মানুষই। বাম থেকে রাম, সব দলের ক্ষেত্রেই এ কথা কমবেশি সত্যি। রাজনীতির সূত্রে কতখানি ঝুলি ভরল, তা দেখার চেয়েও কোনও দলের রাজনৈতিক আদর্শকে তাঁরা কতখানি আপন করে নিচ্ছেন, সে বিষয়টিকেই অনেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। কিন্তু এখন বোধহয় আর সেভাবে সে কথা বলা চলে না। জাতীয় রাজনীতিতে যাওয়া আসার গল্প লেখা হয়েছে আগেও। তবে এই প্রবণতায় ক্রমশ সকলকে পিছনে ফেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে গিয়েছে বর্তমান সময়। যে কোনও কারণেই হোক না কেন, সাম্প্রতিক সময়ে মুহুর্মুহু দলবদলের সাক্ষী রাজনীতির মাঠ। দলে থেকে কাজ করতে না পারাই কারও দলবদলের যুক্তি, কেউ আবার ভোটে দাঁড়ানোর টিকিট না পেয়ে অভিমানে দল ছাড়ছেন। আবার অন্য দলের আমন্ত্রণ পেয়েও দলবদল করছেন কোনও বড় নেতা। কেউ কেউ দল ছাড়লে অভিযোগ উঠছে যে দুর্নীতির অভিযোগ মুছতেই এমন পদক্ষেপ। সদলবলে দলবদল করে রাজ্যের গদিই উলটে দিচ্ছেন কোনও কোনও নেতা। সব মিলিয়ে নানারকম ভাবেই দলবদল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এখনকার রাজনৈতিক শিবির। বিশেষ করে, যে কোনও ভোটের আগে বা পরে যেভাবে ব্যাপক হারে দলবদলের ঘটনা ঘটছে, তাতে কোন নেতানেত্রী কখন কোন দলে থাকছেন, তার হিসেব রাখাও যেন ভার! যে নেতা একসময় এক দলের ভালো কাজের খতিয়ান দাখিল করতেন, তিনিই কদিন পরে সেইসব প্রকল্পকে স্রেফ উড়িয়ে দিচ্ছেন কিংবা ফাঁস করে দিচ্ছেন পুরনো সহকর্মীদের হাঁড়ির খবর। দলবদলের এই দোলাচলে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে দোদুল্যমান এই আমরাই। যারা বুঝেই উঠতে পারছি না, সত্যবাদী আর মিথ্যেবাদীর সেই গল্পের মতোই ঠিক জবাব আসলে কে দিচ্ছে।
আসলে, এইটাই হল কথা। খেলার দলবদলের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্রেফ বাণিজ্য আর বিনোদন। তার সঙ্গে আমজনতার কোনও ব্যক্তিগত উৎকর্ষের যোগাযোগ নেই। কিন্তু রাজনীতি তো তা নয়। তা দেশ ও রাজ্যের প্রশাসনের ঠিকে নিয়েছে। আম মানুষের রোজকার বাজার থেকে ব্যাঙ্কের গচ্ছিত ব্যাঙের আধুলি, সবই সেখানে কোনও না কোনও ভাবে জুড়ে যায়। দলাদলির কোন্দলে কখন সেই টিকে থাকাটুকুই ঘেঁটে যাবে, সেই হিসেব মেলাতেই আমরা জেরবার হয়ে পড়ি তাই। নেহাতই গরিবগুর্বো লোক, বদল আটকানো আমাদের দলের আওতায় নেই। তবে চাই, দল শুধু না বদলাক, আমাদের চারপাশখানা, বেঁচে থাকার নানা করুণকঠিন পদ্ধতি যদি পালটে ফেলা যায়, ভালো হয়। বদল হলে, সেরকমটাই হোক না।