নোলান প্রশ্নাতীত নন। তর্কাতীত তো নন-ই। অস্কার না-পেলেও তিনি যা, অস্কার পেলেও তাই-ই। তবে নোলান আমাদের সেই সহজপাঠ যা সৃষ্টি-স্রষ্টা সম্পর্কের একেবারে অ-আ-ক-খ’তে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যা ভুলে গেলে বিনোদনের রাংতাটুকুই পড়ে থাকে।
তিনি গতকালও শ্রেষ্ঠ ছিলেন। আগামিকালও থাকবেন। মাঝখানে শুধু আজকের দিনটা, যেদিন তাঁর হাতে অস্কারের স্বীকৃতি। পুরস্কারমাত্রই তা রাজনৈতিক। কোনও সৃষ্টিই রাজনীতির বাইরে নয়, অতএব অস্কারপ্রাপ্তির রাজনীতি সরিয়ে আমরা চোখ রাখতে পারি ক্রিস্টোফার নোলানের বক্তব্যে। দীর্ঘ দু-দশকে একাধিক বার মনোনয়ন এবং খালি হাতে ফেরা। ঠিক তার পরে যেদিন প্রাপ্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছলেন, সেদিন তিনি ভাসিয়ে দিলেন তাঁর সবিনয় নিবেদন। বললেন, একশো বছরের বেশি সময় ধরে সিনেমার সফর চলছে। এই মাধ্যম যে উৎকর্ষের কোন কোন বিন্দু আগামীতে স্পর্শ করবে, তা আজও আমাদের অজানা। সেই সোনার যাত্রায় তাঁরও যে একটুখানি অর্থপূর্ণ ছোঁয়া থেকে গেল, সেটিই তাঁর সবথেকে বড় প্রাপ্তি।
যিনি বলছেন, এ-কথা তাঁকে অস্কারজয়ী খেতাবে নিশ্চিতই আমরা বেঁধে ফেলব না। তিনি ‘ইনসেপশন’, ‘ডানকার্ক’, ‘দ্য প্রেস্টিজ’ বা ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এর মতো ছবি রচনা করেছেন। সিনেমার ভাষাকে নিজের মতো করে ভেঙে গড়ে তৈরি করেছেন নতুন একটি পথ। যে কোনও বড় শিল্পী সেই কাজটিই করে থাকেন। মাধ্যমের আবহমান ঐশ্বর্য আত্মায় ধারণ করে তাকে নতুন গতি দেন। যা ঋদ্ধ করে মাধ্যমটির পথচলা। ক্রিস্টোফার নোলান সেই ঘরানারই পথিক। তিনি তর্কাতীত নন। বরং তাঁর ছবি তর্কের জন্মই দিয়েছে। সিনেমাশিল্পে তিনি কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নন। বরং তিনি সেই আন্দোলন, যা তাঁর শিল্পকে দিয়েছে নতুন মাত্রা, নতুন আঙ্গিক। অস্কার দিয়ে স্রষ্টাকে মাপতে যাওয়া বৃথা। আর সেই কথাটি অস্কারের মঞ্চেই মনে করিয়ে দিয়েছেন নোলান। খেয়াল করে দেখার মতো তাঁর বক্তব্যের দুটি অংশ। সিনেমাধ্যমে তাঁর স্বল্প হলেও থেকে যাওয়া এই ‘অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ’। এবং সেই সঙ্গে দুনিয়া জুড়ে থাকা সেই সব মানুষকে স্বীকৃতি, যাঁরা তাঁর নির্মিত শিল্পভাষায় বিশ্বাস রেখেছেন। এই বিশ্বাস শুধু ‘ওপেনহাইমার’-এ রাখার কথা তিনি বলছেন না। তর্কযোগ্য ভাবে ‘ওপেনহাইমার’ হয়তো তাঁর শ্রেষ্ঠ সিনেমাও নয়, ভাবীকাল তা আরও নিখুঁত বিচার করতে পারবে। নোলান তাই বলছেন তাঁর সমগ্র শিল্পীসত্তার কথা। তাঁর ভাবনা, তাঁর ভাষা, তাঁর জার্নির কথা।
-: আরও শুনুন :-
অস্কারের মঞ্চে আলো কাড়ল মেসি! তবে ফুটবলার নন, কুকুর
নোলানের এই বক্তব্য অনেক দিক থেকেই আমাদের দৃষ্টি বদলে দেয়। একজন শিল্পীকে আমরা কী ভাবে দেখব? বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি ধরে তাঁকে বিশ্লেষণ করতে হলে, এই সামগ্রিকতাতেই ছেদ পড়ে। একজন সিনেমা পরিচালক, সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী- সকলের জন্যই এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রযোজ্য। সৃষ্টির সরণিতে যাঁরা একবার পা রেখেছেন, এবং হেঁটে চলেছেন, তাঁদের সফরসঙ্গী হওয়ার মধ্যেই আছে সৃষ্টির বিস্তার। বিচ্ছিন্ন উক্তির মতো তাঁদের একখণ্ড ভাবনা তুলে ধরে মূল্যায়নে বোধহয় স্রষ্টার প্রতি অবিচারই করা হয়। সৃষ্টি তো জীবনব্যাপী হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়া। যদি শিল্পীকে সম্মান জানাতে হয়, তাহলে সেই গোটা যাত্রাপথকেই খুঁটিয়ে দেখতে হয়। সকল সাফল্য-ব্যর্থতা, স্ববিরোধিতা মিলিয়েই যে সমগ্রের ধারণা, তার কাছে পৌঁছতে হয়। নয়তো শিল্পী এবং ভোক্তা দুয়েরই লোকসান। সম্পর্কটাই তিক্ত হয়ে দাঁড়ায়। ভাবুন তো একটা গানকে যদি একখানা অন্তরাতেই বিচার করা হয়, তাহলে আর গোটা গানটার বাকি অংশের কী গুরুত্ব থাকে! অতএব নোলান বলছেন শিল্পী এবং শিল্পরসিকের একযোগে সমগ্রতায় পৌঁছনোর কথা। বলছেন পারস্পরিক বিশ্বাসের কথা। ফাটকা বিনোদনের উত্তেজনা সরিয়ে রেখে, শিল্পচর্চা ও বিচারের ক্ষেত্রে এর থেকে দামি কথা বুঝি আর হয় না।
-: আরও শুনুন :-
পুরুষের নগ্নতা হাসির খোরাক! প্রশ্ন জাগিয়ে দিল অস্কারের মঞ্চ
আর এই কথা কে বলছেন? না, ক্রিস্টোফার নোলান। যিনি অস্কার পান বা না-পান, সিনেমাশিল্পের একান্ত সাধক। অস্কার হাতে নিয়েও তিনি ঐকান্তিক ভাবে বিনয়ী। অল্পের জন্য স্বীকৃতি হাতছাড় অ্যাথলিটের মতো হয়তো এতদিন তিনি জানতেন, স্বীকৃতির গল্প কতখানি আপেক্ষিক! অতএব শেষমেশ যখন তা সম্ভব হল, তখনও তিনি তাঁর এতদিনের বিশ্বাস থেকে সরে আসেননি। দুনিয়াজোড়া উচ্চকিত সময়ে এই মৃদু স্বরও প্রণিধান যোগ্যা। বিন্দু সাফল্যে সিন্ধু উদযাপনের যুগে নোলান জাজ্জ্বল্যমান ব্যতিক্রম। তিনি ফিরে যাচ্ছে অতলান্ত সিনেমাশিল্পে তাঁর অর্থপূর্ণ একটুকু অবদানের প্রসঙ্গে। লিওনেল মেসি একবার বলেছিলেন, প্রতিবার যখন তিনি ফুটবল খেলতে নামেন, খেয়াল করেন, ফুটবলকে যেন তিনি আর-একটু উৎকর্ষে পৌঁছে দিতে পারেন। আসলে ‘বড়’ মানুষদের ‘ছোট’ হয়ে থাকতে অসুবিধা হয় না। এই বামনের পৃথিবীতে নোলানের এই সবিনয় নিবেদন কি তাই শিক্ষণীয় নয়?
নোলান প্রশ্নাতীত নন। তর্কাতীত তো নন-ই। অস্কার না-পেলেও তিনি যা, অস্কার পেলেও তাই-ই। তবে নোলান আমাদের সেই সহজপাঠ যা সৃষ্টি-স্রষ্টা সম্পর্কের একেবারে অ-আ-ক-খ’তে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যা ভুলে গেলে বিনোদনের রাংতাটুকুই পড়ে থাকে। সেই চকচকে রাংতা নিয়ে কতদূর আর যাওয়া যায়! বরং নোলানের কথা, তাঁর ভাবনায় চোখ রাখলে পথের সন্ধান মেলে। যে-পথ খণ্ডিত নয়, বিচ্ছিন্নতার নয়, সমগ্রের।