ভয়। মানুষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে, তার মধ্যে অমোঘ এক চালিকাশক্তি। যা যা কিছু তাকে কষ্ট করে শিখতে হয় না, তার অন্যতম।
মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি।
কয়েকটি শব্দে যে এমন হাড় হিম করা ‘আতঙ্ক’-কে পুরে দেওয়া যায়, সে কথা জানিয়েছিল একটি ছবি। নিজের চোখের সামনে কন্যার শ্লীলতাহানির ঘটনা দেখেও সেখানে মুখ বুজে থাকতেন প্রবীণ শিক্ষক। কেননা ভয়। তিনি কিছু দেখে ফেললে তাঁর মেয়ের মুখে অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দেওয়া হয়েছিল। সেই ভয়ের সামনে ঢাল-তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো একা দাঁড়িয়ে তিনি আর কিছুই করে উঠতে পারেননি।
কিছুই করে উঠতে পারেনি নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্পের সেই লোকটিও। কেবল জনে জনে প্রশ্ন করা ছাড়া। একটি প্রশ্নই কেবল তাকে তাড়া করে বেরিয়েছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত- আমার কোনও ভয় নেই তো?
আরও শুনুন:
মজুরি কাটার ভয়! ঋতুস্রাব এড়াতে জরায়ুও কেটে বাদ দিয়েছেন মহিলারা
ভয়। মানুষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে, তার মধ্যে অমোঘ এক চালিকাশক্তি। যা যা কিছু তাকে কষ্ট করে শিখতে হয় না, তার অন্যতম। কারণ ভয় কী, তা তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য দিকে দিকে খাড়া আছে পাহারা। এই ধরুন না, চন্দ্রবিন্দুর গান শোনার অনেক আগেই আপনি জেনে গিয়েছিলেন, জুজু ধরলে কী হয়। সেই শিশুবেলাতেই আপনার কানে মন্ত্র জপ করা হয়েছে, খাবার শেষ না করলে জুজু আসবে, অন্ধকারে গেলে জুজু ধরবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ছোটবেলা কাটিয়ে বড় হলেন বটে, কিন্তু জুজুর ভয় কি কাটিয়ে ওঠা গেল? বরং দেখা গেল কখনও পরিবার, কখনও প্রতিষ্ঠান, কখনও ধর্ম, কখনও রাষ্ট্র আপনাকে নানাভাবে জুজু-র হুঁশিয়ারি দিয়েই চলেছে। ছোটবেলায় নম্বর না পাওয়ার ভয় দেখাচ্ছে স্কুল। বড়বেলায় মন জুগিয়ে কাজ না করলে আসছে ছাঁটাই হওয়ার ভয়। সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেলে নাকি ঠাকুর পাপ দেবেন আর ভিনধর্মে বিয়ে করতে চাইলে সমাজ দেখাবে ‘অনার কিলিং’-এর ভয়। আপনি কাগজ দেখাতে না চাইলে রাষ্ট্র এনআরসি-র ভয় দেখাবে, আর আপনি সরকারের কাজকর্মের কাগজ থুড়ি প্রমাণ দেখতে চাইলে হয়তো লাগু হবে ইউএপিএ। নয়ত সব ধরনের অঙ্ককেই পাকিস্তান দিয়ে গুণ করে ফেলা হবে, আর সেই ভয়ে আপনি ক্রমে ক্রমে মুখে কুলুপ এঁটে ফেলবেন। সব মিলিয়ে দেখবেন, এদিকে ভয়, ওদিকে ভয়, মাঝখানে ক্রমশ গুটিসুটি মেরে নিজের খোপের মধ্যে ঢুকে পড়ছেন আপনি। উটপাখির মতোই আপনারও ভাবতে ভালো লাগছে যে এখানে কোনও ভয় নেই।
আরও শুনুন:
সোশাল মিডিয়ায় লকডাউন! অ্যাকাউন্ট নাকি নিজের ইমেজ হারাবার ভয়েই হাহাকার?
আসলে ব্যাপারটা হল, আপনাকে ভয় ধরিয়ে দিতে পারলেই উলটোদিকের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভয় কমে যায়। ভাবছেন, আপনি যার ভয়ে থরহরিকম্প, তার আবার ভয় কীসের? ভয় হবে না? যদি কোনও দিন আপনি তাকে ভয় না পান, সেটাই তো তার সবচেয়ে ভয়ের জায়গা। তাই সেই ভয় দেখাবার ব্যবসা তাকে চালিয়ে যেতেই হয়। রক্তকরবীতে জালের আড়ালে থাকা যে রাজাকে সকলে ভয় পায়, নন্দিনী তার দিকেই সপাটে প্রশ্ন ছুড়েছিল, “লোকে তোমাকে ভয় করে, এইটে দেখতে ভালোবাস? আমাদের গাঁয়ের শ্রীকণ্ঠ যাত্রায় রাক্ষস সাজে— সে যখন আসরে নামে তখন ছেলেরা আঁতকে উঠলে সে ভারি খুশী হয়। তোমারও যে সেই দশা।” আসল কথা হল, একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচার এই সমস্তই আদপে ভীষণ ভীতু। সে জানে, যে কোনও সময়, সামান্য ফুৎকারে উড়ে যেতে পারে সে। তাই সে অন্য সমস্ত স্বরকে দমিয়ে রাখতে চায়, পাছে কেউ তার জায়গাটি কেড়ে নিতে আসে! এ আসলে যে কোনও ক্ষমতারই মূল কথা। তাই যে কোনও অস্ত্রের থেকেও, মুক্তচিন্তা, যুক্তি, বুদ্ধি, সর্বোপরি মুক্ত সংস্কৃতিকে ভয় পায় ক্ষমতা। যা কিছু মানুষের মনে মুক্তচিন্তার খোরাক জোগায়, তা তো চেনা ছকের বাইরের কথা বলে। আর অচেনা কিছুকেই ক্ষমতা ভয় পায়। মানুষ নিজের মতো ভাবলে, নিজের মতো বললে, নিজের মতো চললে, সে যদি ক্ষমতার ঠিক করে দেওয়া নিয়ম আর না মানতে চায়, তাহলেই তো তার গদি টলমল করে উঠবে। তাই ক্ষমতা ভয় দিয়েই মানুষের মগজ ধোলাই করে। মগজ ধোলাই করার পরেও যেটুকু বিবেচনাশক্তি বাকি থাকে, তা আইনের ভয়ে আটকে যায়। আর নইলে আসে মারের ভয়। তাতে শুধু এক জায়গায় কথা বন্ধ হয় না, বাকি সব কথা বলার সম্ভাবনাকেও রুখে দেওয়া যায়।
ক্ষমতার ভয় এইখানেই যে, মারের মুখের উপর দিয়ে তবুও কেউ কেউ ফুল আনার কথা ভাবে। ভাববেও।