আখ যতটা মিষ্টি, সেই আখ চাষের খেতেই লুকিয়ে আছে এক তেতো সত্যি। যে কথা জানেন কেবল চাষের জমিতে কাজ করা মহিলারা। ঋতুচক্রের দিনে মজুরি হারানোর ভয়ে যাঁরা শরীরে জরায়ু ধরে রাখারও সাহস পান না। শুনে নেওয়া যাক সে কথা।
সম্প্রতি জিডিপি বৃদ্ধির হার জানিয়েছে, দেশের কাজের দুনিয়ায় মহিলাদের অংশগ্রহণের হার বাড়ছে। কিন্তু তার মানেই কি এ দেশে মহিলাদের কাজের পরিবেশ উন্নত হচ্ছে? মহিলাদের জন্য কাজের সুযোগসুবিধার দিকটিতে নজর পড়ছে বেশি করে? এ প্রশ্ন খতিয়ে দেখতে হলে নারী-কর্মীদের কাজের ক্ষেত্রগুলি খুঁটিয়ে দেখতে হয়। আর সেখান থেকেই উঠে আসে কোনও তেতো সত্যি কথা। যেমন সামনে এসেছে চাষের মাঠে কাজ করা নারীদের জরায়ু কেটে বাদ দেওয়ার কথা। হ্যাঁ, শুনতে যতই অবিশ্বাস্য লাগুক, আদতে সত্যি। জানা যাচ্ছে, মহারাষ্ট্রে আখ চাষে যুক্ত প্রায় ৩০ হাজার নারী-শ্রমিক অস্ত্রোপচার করে জরায়ু বাদ দিয়েছেন। কারণ, ঋতুচক্রের দিনগুলোয় তাঁরা মজুরি থেকে বঞ্চিত হন। দিন আনা দিন খাওয়া জীবনে একদিনের মজুরি কাটলেই বা চলবে কী করে! তার উপরে এক দিন কাজে না গেলে উলটে জরিমানা দিতে হয় সেখানে। এক দিনের মজুরি মোটামুটি ২৫০-৩০০ টাকা, আর জরিমানা বা ‘খাদা’র পরিমাণ ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। এই অবস্থায় মহিলারা নাচার। নিয়োগকর্তা যেখানে নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি বিচার করে কোনও সহানুভূতি দেখাচ্ছেন না, সেখানে মহিলারা হিস্টেরেকটমিকেই সহজ সমাধান বলে বেছে নিয়েছেন।
আরও শুনুন:
বাবার পদবি ব্যবহার করতে লাগবে স্বামীর অনুমতি! এ দেশের মেয়েদের বড় হতে নেই?
মনে রাখা দরকার, আমরা যে সময়ে এ কথা বলছি, সে সময়ে কর্মক্ষেত্রে পিরিয়ডসের ছুটি পাওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে। ঋতুস্রাবের দিনে মেয়েদের পক্ষে টানা শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করা যে কতটা কষ্টকর, সে কথা তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তা নিয়ে যে ভাবা যায়, ভাবা উচিত, সে কথা ভাবারই পরিসর তৈরি হয়নি আমাদের সমাজে। তাই ঋতুকালীন ছুটির প্রস্তাব অঙ্কুরেই মিলিয়ে যায়। যাঁরা এই সমাজটার হালহকিকত নিয়ে সচেতন, তাঁরা আড়ালে বলেন, এ ছুটি মঞ্জুর হলে নারী কর্মীদের দুর্ভোগ বাড়বে বই কমবে না। কারণ, তাঁদের কাজে নেওয়ার ক্ষেত্রেই অনীহা দেখাবেন অনেক মালিক। ঠিক যেমনটা ঘটে থাকে মাতৃত্বকালীন ছুটির ক্ষেত্রেও। সরকারি খাতায় কলমে ম্যাটারনিটি লিভ মঞ্জুর করা হলেও, সেই ছুটি পেতে অনেকসময়ই মহিলাদের রীতিমতো বাঁকা চোখ আর বিদ্রুপ পেরিয়ে যেতে হয়। যে সমাজে মেয়েদের মাতৃত্বকে তার নারীত্বের চূড়ান্ত মাপকাঠি বলে ধরা হয়, সেই সমাজেই কর্মক্ষেত্র আবার মাতৃত্বকালীন ছুটিকে মেয়েদের অন্যায্য পাওনা বলে মনে করে। এই টালমাটালের মধ্যে দাঁড়িয়ে তাই মেয়েরাই নিজেদের সমস্যা মোকাবিলা করার মরিয়া চেষ্টা করতে থাকেন, যেমনটা করছেন এই চাষের মাঠের মহিলারাও। মাতৃত্ব তো পরের কথা, ঋতুস্রাবের প্রাকৃতিক নিয়মটুকু জিইয়ে রাখা পর্যন্ত তাঁদের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরও শুনুন:
জিডিপি বৃদ্ধির হারে আশার আলো, কিন্তু তার নেপথ্যে কি কর্মসংস্থানের উন্নতি দেখা গেল?
আসলে ঋতুকালীন ছুটি বা মাতৃত্বকালীন ছুটির কথাটুকু অন্তত যেখানে তোলা যায়, সে সরকারি ক্ষেত্র কিংবা তথাকথিত উঁচুতলার প্রাইভেট সেক্টর। কিন্তু এ দেশে অধিকাংশ কর্মরতা মহিলাই কাজ করে থাকেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। তাঁরা অনেকেই অস্থায়ী বা ঠিকা কর্মীও। সেখানে এমনিতেই পুরুষের সঙ্গে তাঁদের মজুরির বিস্তর ফারাক। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা অন্য কোনও সুবিধার কথা তো না তোলাই ভালো। এমনকি মহিলাদের জন্য শৌচাগার পর্যন্ত মেলে না বেশিরভাগ জায়গায়। এই পরিস্থিতিরই একটা কদর্য রূপ সামনে এল চাষের মাঠে কাজ করা এই মহিলাদের ঘটনায়।