বিচ্ছেদ মানেই যেন একজনকে দোষী বলে দাগিয়ে দিতে হবে। সমাজের গড় প্রবণতা দেখলে এমন কথাই মনে হয়। সেই দোষারোপের পাল্লায় এবার নিজের অবস্থান জানাল খোদ আদালতও। সঙ্গী বদলের ঘটনায় কোনদিকে হাঁটছে আইন? শুনে নেওয়া যাক।
প্রেম ভেঙেছে এক জুটির। সে খবর সামনে আসার পরেই হয়তো শোনা গেল, জুটির একজন নিজেকে জুড়ে নিয়েছেন নতুন প্রেমে। আর যায় কোথায়! তাঁর দিকে কখনও কটাক্ষ, কখনও বা তীক্ষ্ণ খোঁচা, কখনও আবার রীতিমতো কটুবাক্যে ছেয়ে গেল নেটদুনিয়া। আজকাল হামেশাই আমরা এমন ছবি দেখে থাকি, তাই না? দুজন মানুষের ব্যক্তিগত বোঝাপড়ার মধ্যে অনায়াসে ঢুকে পড়ে বাইরের যে কোনও মানুষের নিজস্ব ভাবনা, নিজেদের মতামত। যে ভাবনার বেশিরভাগটাই জুড়ে রয়েছে জুটির একজনের প্রতি দোষারোপ। মূলত যে মানুষটি মুভ অন করে গিয়েছেন, তিনিই আদতে দোষী, এমনই অভিযোগের আঙুল ক্রমাগত উঠতে থাকে তাঁর দিকে। তার উপর যদি দেখা যায়, বিচ্ছেদের দুঃখ অন্য একজনের মধ্যে বেশ খানিক ভাঙন ধরিয়েছে, তবে দোষারোপের পাল্লা ভারী হয় আরও। কখনও কখনও মানসিক অস্থিরতাকে সামাল দিতে না পেরে অনেকে নিজের ক্ষতি করার পথেও হাঁটেন, এমনকি আত্মহত্যার মতো পদক্ষেপও নিয়ে বসেন। সেই সময়ে যাবতীয় দায়ভারই গিয়ে বর্তায় প্রাক্তন সঙ্গীর উপর।
আরও শুনুন:
কেবলই ‘বন্ধুর বউ’! মেয়েকে মেয়ের মতো থাকতে দাও…
সম্প্রতি এমনই এক মামলার প্রসঙ্গে এই সঙ্গী বদলের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে আদালত। জানা গিয়েছে, ২০১৬ সালের ১৫ জানুয়ারি মুম্বইয়ের এক যুবক নীতিন কেনি আত্মহত্যা করেছিলেন। তাঁর পরিবারের তরফে এই মৃত্যুর জন্য প্রাক্তন প্রেমিকাকে দায়ী করা হয়। পরিবারের দাবি ছিল, প্রেম ভেঙে ওই তরুণী অন্য সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন। সেই কারণে মানসিক অবসাদ, এবং তা থেকেই আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন যুবক। এরপরেই তরুণীর বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে মামলা দায়ের করে বসেন মৃত যুবকের বাড়ির লোক। এই প্রসঙ্গে আদালতের পর্যবেক্ষণ, নিজের ইচ্ছা, চাহিদা অনুযায়ী প্রেম ভাঙা এবং সঙ্গী বদল করা ভাবে অনুচিত। অর্থাৎ, আদালতের বক্তব্য, ইচ্ছামতো একটি সম্পর্ক ভেঙে অন্য সম্পর্কে ঢুকে যাওয়া ‘নৈতিক ভাবে’ অনুচিত। কিন্তু আইনের চোখ দিয়ে দেখলে, প্রেম ভাঙার কোনও শাস্তি বা সমাধান নেই। প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর কোনও ব্যক্তিকে যে মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার ভিত্তিতে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার কথা বলা যায় না, এমনটাই সাফ জানাচ্ছে আদালত।
আরও শুনুন:
বাবার পদবি ব্যবহার করতে লাগবে স্বামীর অনুমতি! এ দেশের মেয়েদের বড় হতে নেই?
কথা হল, কোনও সম্পর্কের পরিস্থিতি ঠিক কেমন, সে কথা তো বাইরে থেকে বোঝা আদৌ সম্ভব নয়। বিচ্ছেদের নেপথ্যে ঠিক কী কারণ রয়েছে, সে কথাও সবসময় প্রকাশ্যে আসে না। এই বিশেষ মামলার প্রসঙ্গে যেমন তরুণীর আইনজীবী অভিযোগ করেছেন, প্রেম ভাঙার পরেও যুবক তরুণীর পিছু নিতেন, যা তাঁর পক্ষে অস্বস্তিকর ছিল। এখান থেকেই কথা ওঠে, কোনও বিচ্ছেদের নেপথ্যে অধিকারপ্রবণতা, ঈর্ষা, সন্দেহ এমন অনেক কিছুই থাকতে পারে, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। কোনও মানুষের সামাজিক চেহারার ভিত্তিতে তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরকে আসলে বিচার করা যায় না। সুতরাং এই দোষারোপের পালা ঠিক কতখানি যুক্তিযুক্ত? হ্যাঁ, বিচ্ছেদ দুঃখের। সেখানে যদি বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা থাকে, তবে তাও দুর্ভাগ্যের। কোনও কারণে বা অকারণে একটি সম্পর্কে আর থাকা গেল না, এ ঘটনা যতখানি বেদনার, সেই বেদনাই অন্য তীব্রতা পেয়ে যায় যদি তাতে বিশ্বাসভঙ্গের দাগ লাগে। কিন্তু দিনের শেষে এ কথা মনে রাখা জরুরি, যে, যা হচ্ছে তা কোনও যুগলের ব্যক্তিগত পরিসরের বিষয়। সে কথা যদি বা প্রকাশ্যে আসে, যে কেউ তা নিয়ে ইচ্ছেমতো বিচারসভা বসাতে পারেন না। এক পক্ষকে ভিলেন আর অন্য পক্ষকে ভিক্টিম হিসেবে ভেবে নিতেই পারি আমরা, কিন্তু অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেওয়া বা তা নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা কি আমাদেরও রুচির পরিচয় দেয়? আদালতও সেই ব্যক্তিক পরিসরকে গুরুত্ব দেওয়ার কথাই মনে করিয়ে দিল এবার। সেই কথা মেনে আমাদেরও হয়তো আরও একটু পরিণতি আর পরিমিতির দিকে হাঁটাই জরুরি।