শখের আয়না ভেঙে গেলে কষ্ট তো হয়, তার সঙ্গে মনের মধ্যে শুরু হয়ে যায় অমঙ্গলের চিন্তা। সত্যিই কি ভাঙা আয়না বয়ে আনে অমঙ্গলের সংকেত?
আয়নাতে মুখ দেখব না, এই কথা কখনও কাউকে বলতে শুনেছেন? নিজেকে ভালবাসে না এমন কেউ যেমন নেই, আয়নায় মুখ দেখতে ভাল লাগে না এমন লোকজনও খুঁজে পাওয়া ভার। বাড়িতে তো থাকেই, বাইরে যেখানেই যান না কেন, আপনার কাছে ছোট্ট একটা আয়না থাকবে না, এটা হতে পারে না। আয়না তো শুধু আপনার মুখ নয় পড়তে পারে আপনার মনও। তাই আয়নার সঙ্গে একটা সখ্য হয়ে যায়। ওই আয়না ছাড়া আর কোনও আয়নায় মুখ দেখে শান্তি পাওয়া যায় না।
নার্সিসাসের গল্পটা তো সবার জানা। জলে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে নিজের প্রেমে হাবুডুবু। ওটাই ছিল পৃথিবীর প্রথম আয়নায় মুখ দেখা। তখন জলেই নিজের মুখ দেখে খুশি থাকতে হত। প্রায় ২০০ বছর আগে ‘জাস্টিস ভন লাইবিগ’ নামে একজন জার্মান রসায়নবিদ স্বচ্ছ কাঁচের এক পাশে টিন ও পারদের এক ধরনের প্রলেপ দিয়ে আয়না তৈরি করেন। আবার গবেষকদের মতে প্রায় ৮০০০ বছর আগে বর্তমান তুরস্কে আয়না তৈরির করার চেষ্টা হয় আর সেই চেষ্টা সফলও হয়েছিল। আনাতোলিয়ার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গিয়েছিল একটা আয়না। প্রথমদিকে আয়না তৈরি করতে সোনা, রূপা, তামা ব্রোঞ্জ ব্যবহার করা হত। তাই আয়না ছিল সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তখন সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাড়ির দেওয়াল মানেই সেখানে থাকত আয়না।
আরও শুনুন: Ramayana: রামায়ণের আদিতে ছিলই না লক্ষ্মণরেখা! কোথা থেকে এল এই গল্প?
আয়না শুধু শখের নয় সাধের জিনিসও বটে। এই সাধের বস্তুটি যখন ভেঙে যায় মন না চাইলেও তাকে ফেলে দিতে হয়। কেন? ছোটবেলা থেকেই আপনি শুনে আসছেন ভাঙা আয়নায় মুখ দেখতে নেই। আর আয়না ভাঙাও নাকি অলক্ষণের চিহ্ন। সব সংস্কৃতিতেই ভাঙা আয়না নিয়ে সংস্কার রয়েছে। আয়না ভাঙলে সাত বছরের জন্য দুর্ভাগ্যের সঙ্গে চিরস্থায়ী বসবাস নাকি পাকা। রোমানরা এটাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।
হিন্দু শাস্ত্রে আয়না ভাঙা নিয়ে নানারকম সংস্কার রয়েছে। শুনলে অবাক হবেন, সেখানে বলা হয়েছে আয়নায় নাকি ধরা থাকে আত্মার একটা অংশ। আয়না ভেঙে গেলে সেই আঘাত আত্মার ওপর এসে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। দেবতা, অপদেবতারাও নাকি আয়নার মধ্যে দিয়েই যোগাযোগ তৈরি করে। আবার কেউ বলেন, মা লক্ষ্মীর হাতে থাকে দর্পণ। সেটা ভেঙে গেলে লক্ষ্মীদেবীর রুষ্ট হয়, যার পরিণামে আমাদের জীবনে দেখা দেয় অর্থকষ্ট। ভাঙা আয়নার স্বপ্ন নাকি বহন করে আনে প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ।
সেই সময় জিউসের বাড়িতে কেউ মারা গেলে সব আয়না ঢেকে দেওয়া হতো। তাঁরা মনে করতেন আয়না খোলা থাকলে পবিত্র আত্মা সেখানে বন্দী হয়ে যাবে, বেরোতে পারবে না।
একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এইসব সংস্কার মানতে ইচ্ছে করে? মন নিশ্চয়ই খুঁজে বেড়ায় আসল কারণ?
সেই সময় আয়না তৈরি ছিল বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। যত্নে রাখার জন্য হয়তো মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল সংস্কার। শখের জিনিস হওয়ায় ভেঙে যাওয়ার পরেও কেউ রেখে দিতেন, ভাঙা কাঁচের টুকরোয় আহত হওয়ার ভয় থেকেই জন্ম নেয় সংস্কার। অনেকে মনে করেন, আয়নার ভেঙে ফেলার মধ্যে অন্যমনস্কতার ইঙ্গিত থাকে। সেখান থেকেই হতে পারে আরও ভুল। সতর্ক করতেই তৈরি হয় বিধিনিষেধ।
সংস্কার, কুসংস্কারের বেড়াজাল পেরিয়ে পছন্দের আয়নাকে যত্নে রাখতে হবে এটাই শেষ কথা। তবেই তো বলতে পারব, বল তো আরশি তুমি মুখটি দেখে।