সম্প্রতি চলে গেলেন কিংবদন্তি কুমার সাহানি। ভারতীয় সিনেমা যাঁর হাত ধরে পেয়েছে অনন্য মাত্রা। চিনেছে দৃশ্যের শিল্পে আধুনিকতার স্বর। তাঁর ছবির পরতে পরতে রাখা দেশের আত্মা আর আগামীর সংকেত। সাহানির সিনেদর্শন তাই আমাদের নিয়ত ভাবায়, প্ররোচিত করে নিজেদের অবস্থান চিনে নেওয়ায়, আত্ম-অনুসন্ধানে। লিখছেন, অমিত মুখোপাধ্যায়।
আগাগোড়া এক স্বকীয়তা খেলা করে কুমার সাহানির দৃশ্যকাব্যে, যেখানে অতীত ইতিহাস, স্বাধীনতার সময় বা পরবর্তী জীবন, সর্বত্রই এক ধ্রুপদী সুর বেজে চলে। ছোট ছবি হোক বা বড় কাহিনি, সাহানি ক্রমাগত মগ্নতায় ডুব দিয়েছেন, কখনো অন্তর্ঘাতের পর্যায়ে চলে গেছে তা।
চলচ্চিত্রের ভাষা শিখেছেন, তাঁর দর্শন বদলে দিলেন ঋত্বিক, অলংকার বর্জন করার শিক্ষা দিলেন ব্রেসঁ, সংযমে শান দিলেন রসেলিনি আর গঠনের ধারণা দিলেন আইজেনস্টাইন। বাইরের আর ভেতরের বাস্তবতা মিলে গেল মেদুর রঙবাহারে আর সূক্ষ্মতায়। ‘মায়াদর্পণ’ থেকে ‘কসবা’, অন্তরঙ্গের স্বল্প আলোর সন্ধানী রেখা চিনিয়ে দেয় বহিরঙ্গের উজ্জ্বলতার জগতকে।
প্রথম দিকে তিনি সমালোচিত হন ধীর চিত্রগ্রহণ, গল্পের মন্দ লয়ের জন্য। পরে বোঝা যায় সেই শ্লথতার অর্থ, তার মাহাত্ম্য, যখন মায়াদর্পণ-এর তরন মেয়েটি ঘরের ভেতরের সাধারণ নড়াচড়ায়, হাত বা পায়ের আঙুল নাড়ানোয়, লুকিয়ে রাখায়, এমনকি স্রেফ বসে থাকায় প্রকাশ করে যুগসন্ধিক্ষণের দোদুল্যমানতা, ভারত যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করে চলেছে। দূরাগত শব্দ, অস্পষ্ট গানের আভাস যেন সেই স্বাধীনতার পর্বান্তরের চেহারা ধরতে চায় পাষাণকারার অচলায়তনের ভেতর থেকে। দৃশ্য যখন বাইরের, তখনও সামান্য হরতাল ইত্যাদি কথা, পুলিশের মারার ঘটনা ছাড়া আর থাকে আলোচনার হাহুতাশ। আশ্চর্য দক্ষতায় তিনি সময় ও পরিসরকে গেঁথে ফেলেন, সেই প্রেক্ষিতে বিস্তারের ধারণা দিতে ওই মন্থরতার দরকার ছিল।
মায়াদর্পণ-এর ধীরতা আরও নানা ভাবে আকর্ষণ করে রসগ্রাহীদের। এক সাম্রাজ্য জায়গা ছেড়ে দিতে চাইলেও নতুন ব্যবস্থা অজস্র দ্বিধা নিয়ে এগোয়। শ্রমিক কর্মচারী শাসক বা আধিপত্য হারাতে থাকা ক্ষমতার মালিক, কেউই খুশি নয় সদ্য পাওয়া স্বাধীনতায়। তাই প্রত্যেকে অতি সতর্ক ভাবে পা বাড়ায়। এমনকী শেষে তরন যখন বাবার সামাজিক সম্মান বজায় রেখে নিজের ইচ্ছে মেটানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখনো তা ঘটে অতি শান্ত পরিস্থিতিতে! ভাবুন সেই দৃশ্য, কলঘরে গিয়ে একের পর এক চুলের কাঁটা খোলে তরন, বেশবাস ঠিক করে, সতর্ক পায়ে বাবার ঘরের দিকে যায়, দরজা বন্ধ দেখে স্থির ভাবে বেরিয়ে পড়ে প্রেমিকের ডেরার দিকে। যাবার আগে মাসির প্রশ্নে বলে যায় নিজের সিদ্ধান্তের কথা। ঘর ছেড়ে যাবে না, এ কথা সে আর বলে না। তার উক্তি, কোনও ভাবেই তার বাড়ি যাওয়া চলে না!
ট্রেনের চাকার চলে যাবার শব্দকে নানা মাত্রায় প্রয়োগ করেন সাহানি। ইঞ্জিনের শিসও যেন প্রতীকী হয়ে ওঠে। কলের জল বালতিতে পড়া, বাতাসের আওয়াজ থেকে দিনান্তের ম্লান আলোয় নিসর্গের শূন্যতা, রুক্ষ মাটি, বালিয়াড়ি সময় ও মানসকে তুলে ধরে। শেষের সেই নাচের দৃশ্যে অনেকেই ভারতনাট্যমের লৌকিকতার সঙ্গে অজন্তার মুদ্রার মিল পেয়েছেন। সেই দৃশ্যে জনতার ভূমিকা বুঝি স্বপ্নের মঞ্চায়ন! তা ছাড়া এমন রক্ষণশীল সামন্ততান্ত্রিক অবশেষের মাঝ থেকে জেগে ওঠা তরন যখন প্রেমিকের হাত নিজের বুকে নেয়, তার অভিঘাত অনেক কিছু বলে দেয়।
‘তরংগ্’ সেই তুলনায় সরলরৈখিক ভাবে বলা হলেও সেখানেও চোরাগোপ্তা মন্তব্য ও কাজকর্মে সাহানির তীব্র বিশ্লেষণ নজর কাড়ে। যেমন কিছু গান এখানে দর্শককে চমকে দেয়, তেমনই ঘুরে ফিরে আসে শ্রমের মূল্যের প্রসঙ্গ। যে দৃশ্যে হংসা আত্মহত্যা করে, তার আগেকার গানের সময়ে অনুমান করার কোনও আভাস থাকে না। স্নানের পাত্রে নিজের ছড়ানো ফুলের (যে ফুল কাজের মেয়ে জানকিকে দিয়ে আনানোর সময়ে সে বলেছিল, একমাত্র তুইই আমার মনের অবস্থা বুঝবি!) মাঝে তার অন্তিম শয়ান গানের মতোই স্বকীয় উন্মোচনে ভাস্বর। চারপাশের দালালি, অবিশ্বাস, হিংস্রতা যেন ইংরেজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে চলে, যার হিমশীতল পূর্বাভাস ছিল মায়াদর্পণে, তাই অমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল তরনকে! নেতৃত্ব, প্রশাসন, মালিক, শ্রমিক তখনও দেখা যায় মারামারি করেই চলেছে! অসম্ভব নেতির উদাহরণ রাখে অমল পালেকরের রাহুল চরিত্র, দেশের পরের প্রজন্মের অমন রূপ থমকে দেয়। উদ্দেশ্যসিদ্ধি করে জানকিকে তাড়িয়ে দেবার পরে রাতে দীর্ঘ সেতুর ওপরে যখন রাহুল ফের দেখা পায় তার, সেই দৃশ্য একই সঙ্গে স্বপ্ন এবং সমাপন হয়ে থাকে। এই ধরনের সব চরিত্রের মূল সঙ্কট ধরতে পারে জানকি। সে আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলে, তুমি আদতে চরম ভয়ে আছ নিজেই! যখন রাহুল তখন অবধি তাদের মাঝে চাপা থাকা “সব কুছ আনকহা” খুলে বলতে চায়, হেসে উড়িয়ে দিয়ে চলে যায় সামান্য মেয়েটি।
কেন্দ্রীয় চরিত্রে এই ভাবে বারংবার নারীকে জোরালো আলোয় দেখতে চান সাহানি। এরাও যে মেঘে ঢাকা তারা! নিজের সমস্যার মাঝেই তারা পোক্ত হয়, সচেতন হয়, নির্ণায়ক হয়ে ওঠে। ‘কসবা’ ছবিতেও পরবর্তী সময়ের ব্যাধির প্রকট চেহারা দেখিয়ে চলেন পরিচালক। দৃশ্যগ্রহণ চলে চরিত্রের বাইরের ও মনের চলনের সমান্তরালে। দরজা জানলাকে ব্যবহার করা হয় বাইরের বাস্তবতাকে প্রকট করতে, সামাজিক অবক্ষয় চূড়ান্ত চেহারায় ফুটে ওঠে। ‘খেয়ালগাথা’ও আরেক ফলক-নির্মাণ, যেখানে চিত্রকাঠামোর পরপর সজ্জায় রাজত্বের অবসানের সঙ্গে সম্পর্কের পরিবর্তনের রেখা ধরা থাকে খেয়ালের সুরের আবহে। সঙ্গীত যে স্মৃতি ঘিরেই আবর্তিত হয়, তা পর্দায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সিনেমাকে সত্যিই বাস্তবের হাত থেকে উদ্ধার করে, তাকে বস্তুনিরপেক্ষ করে, শিল্পিত আগামীর সংকেত দিয়েছেন সাহানি। এ আরেক ধার্মিকতা, যা সারা জীবন ধরে মগ্ন হয়ে পালন করে গেছেন তিনি, পণ্যব্যবসাকে উপেক্ষা করেই!