বাবুজি ধীরে চলনা… ইমোজি মে যরা সমাহলনা…। সামান্য জিনিস। কিন্তু বিরাট শক্তি। ভুল করে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে গিয়ে পড়লে আর রক্ষে নেই। কী কথার যে কী মানে হবে, আর তাতে কারা যে চটে লাল হয়ে যাবে তার ঠিক নেই। আজ্ঞে হ্যাঁ, বলছি ইমোজির কথা।.এই যে টুকুস টুকুস করে রাতদিন ইমোজি পাঠান, বলি, সবগুলোর মানে জানেন তো?
এককালে কথা হত, চোখে চোখে। মুখের ভাষার আর দরকার পড়ত না সে কথোপকথনে। আজ দূরত্বই তো নিউ নর্মাল। কে কোথায় বসে আছে তার ঠিক নেই। চোখে চোখে কথা হওয়ারও তাই তেমন জো নেই। কিন্তু কুছ পরোয়া নেহি। হাতে রইল পেনসিল… থুড়ি ইমোজি। মনের কথাটি মুখে না আসুক, অন্যের চোখে পড়ার জন্য টুক করে একটা ইমোজি পাঠিয়ে দিলেই হল। আপনার হাসি রাগ অভিমান টুক করে পৌঁছে যাবে অন্যের কাছে।
এখনকার দিনে তো আমাদের কথাবার্তার বেশিরভাগটাই জুড়ে আছে সোশাল মিডিয়ায়। সেখানে একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিভিন্ন সংকেত। যার পোশাকি নাম হল এই ইমোজি। দেখে মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, আবার কি ইশারা ইঙ্গিতে কথা বলার দিন ফিরে এল!
আমরা জানি, মনের ভাব বোঝানোর জন্য সেই বহুযুগ আগে আদিম মানুষ ভরসা রেখেছিল সংকেত বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে। বিভিন্নরকম ইশারা, ইঙ্গিত, সংকেত, এই ছিল তাদের মূলধন। তারপর তৈরি হল ভাষা। এল তার লিখিত রূপ, অর্থাৎ লিপি। মিশরীয় বা সুমেরীয় লিপিও ছিল ছবি আঁকা। কিন্তু তার সঙ্গে কোনও মিল পাওয়া যাবে না আজকের ইমোজি সিরিজের।
আরও শুনুন: ৩৫ বছর পর কঙ্কাল নিয়ে ফিরেছিল হারানো বিমান, কী সেই রহস্য?
তা এই বস্তুটি এল কোথা থেকে? শব্দ নেই বলে নয়, শব্দের বিকল্প হিসেবেই এদের আমদানি। নয়ের দশকে জাপানের একটি টেলিকম কোম্পানির কর্মীরা প্রথম ইমোজি আবিষ্কার করেন। আর এখন তো শব্দ না লিখে, ইমোজির মাধ্যমে কথা বলার চল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে গোটা বিশ্বেই। মুশকিলটা অন্য জায়গায়। কথা না বলতে গিয়ে, ভুল কথা বলে ফেলছেন না তো? তাহলে কিন্তু চিত্তির!
ধরুন, আপনার বস আপনাকে মেসেজ করে জানালেন, মাইনে বেড়েছে। আপনার প্রাণে খুশির তুফান উঠল। উৎফুল্ল হয়ে পাঠিয়ে দিলেন দু’চোখে লাভ সাইন ওয়ালা ইমোজিটি। আপনি জানলেনই না, ওই ইমোজিটি মোটেই আপনার উল্লাস জাহির করছে না। ওর মানে হল গিয়ে, ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’। আপনার বস যদি হন মহিলা আর আপনি পুরুষ, তাহলে আপনার প্রোমোশনের ভবিষ্যৎ সেদিনই অন্ধকার।
ইমোজির চরিত্র এরকমই। তা যতটা ওপেন করে, ততটাই গোপন করে। কিন্তু সেই ধোঁয়াশা কাটানোর দায়িত্ব ইমোজি প্রেরকের নয়, প্রাপকের। আর ‘ইমোজি কথোপকথন’-এর এই ‘বুঝে নেওয়া’ নিয়েই গোলমাল। কেউ কেউ বলছেন, এই বুঝে নিতে গিয়েই ভুল বোঝার ঘটনা ঘটছে প্রচুর। এক চিহ্নের এক-একরকম অর্থ দাঁড়াতে পারে এক-একজনের কাছে। আপনি বললেন এক কথা, অন্যেরা বুঝল আরেক। দু’হাত খোলা, হাস্যমুখের ‘হাগিং ফেস’ ইমোজিটি অনেকে সম্ভাষণ জানানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন। কিন্তু, আদতে তা জড়িয়ে ধরা বা ‘হাগ’-এর ইমোজি। দু’হাতে সামনে ঝুঁকে পড়া ‘পার্সন বাওয়িং’-এর ইমোজিকে বহু মানুষ মনে করেন, মাথা নিচু করে, সামনে ঝুঁকে বিশ্রামের প্রতীক। কিন্তু আদতে তা কাউকে অভিবাদন জানাতে ব্যবহার করা উচিত। মাথার ওপর তারা ঘুরছে, বিস্ময় বোঝাতে অনেকেই ব্যবহার করেন এই ইমোজি। কিন্তু জানেন কি, এই ইমোজি শুরু হয়েছিল মাথা ঘোরা বোঝাতে!
আরও শুনুন: World Map: বদলে যেতে পারে পৃথিবীর মানচিত্র, কেন জানেন?
এমনকী, একই ইমোজির মানে বদলে যেতে পারে বিশ্বের এক এক প্রান্তে। যেমন ধরুন, ‘জোড় হাত’ ইমোজি। বাঙালিরা ভাববেন, এটি নমস্কারের চিহ্ন। কেউ ভাববেন প্রার্থনা। আবার একে হাততালি বা ‘হাই ফাইভ’ বলেও ভাবেন টিনএজাররা। এদিকে ইমোজি বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ওটি আদতে জাপানি সংস্কৃতি অনুযায়ী ধন্যবাদ বোঝায়।
২০১৫ সালে বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েছিল ইমোজি। তখন মুখগুলি ছিল হলুদ রঙের। তাই অভিযোগ উঠেছিল বর্ণবিদ্বেষের।
যে যাই বলুন, বোঝা যাক আর না যাক, ভারচুয়াল কথোপকথনে ইমোজি নেই, এ আর ভাবাই যায় না এখন। অস্ট্রেলীয় ইমোজি বিশারদ জেরেমি বার্জের সৌজন্যে ইমোজির জন্য আস্ত একটা দিনই বরাদ্দ হয়েছে। দিনটি ১৭ জুলাই। সেদিন সোশাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিং টপিক ইমোজি। বিশেষ করে বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিত্যনতুন ইমোজি নিয়ে প্রচারে নেমে পড়ে। জানেন কি, সলমন খান একবার নিজের নতুন ছবি প্রচারের জন্য বাজারে এনেছিলেন একটা নতুন ইমোজি!
কেউ কেউ বলেন, কথা না বলা এই কথোপকথনে আবেগের নদী নাকি শুকিয়ে যাচ্ছে। বালাই ষাট! তাই বা হতে যাবে কেন? যুগের প্রয়োজনে বদলায় যোগাযোগের ভাষা। সেই ভাষাই সম্বল হয়ে ওঠে মানুষের। যদি ইমোজির চলাচলে মনের কথাটি বলা একবার হয়ে যায়, ক্ষতি কী!
কার তাতে কী, যদি এই প্রজন্ম ইমোজিতেই বলে ফেলতে পারে… ভালোবাসি…।