শাড়ির বদলে প্রাচীন যুগের ধাঁচে পোশাক পরানো হয়েছিল সরস্বতীর মূর্তিকে। কিন্তু সে পোশাক যথেষ্ট শোভন নয়, এই অভিযোগেই সরব হল গেরুয়া শিবির। অথচ যে সনাতনী সংস্কৃতির প্রসঙ্গ টেনে এই পোশাক বিতর্ক, সেই আমলে কি সত্যিই শাড়ি পরতেন ভারতীয় মহিলারা? শুনে নেওয়া যাক।
সরকারি আর্ট কলেজে ঢুকে সরস্বতী মূর্তির গায়ে শাড়ি জড়াল বজরং দল ও এবিভিপি। সরস্বতী প্রতিমার পোশাক শালীন নয়, এই মর্মে আপত্তি তুলে সমর্থকদের দাবি, মূর্তির পরনে শাড়ি ছিল না বলেই এ কাজ করা হয়েছে। এমনকি শেষমেশ গোটা মূর্তিকেই জড়িয়ে দেওয়া হয় কাপড়ে। যদিও ওই আর্ট কলেজের তরফে জানানো হয়েছে, আসলে প্রাচীন ভারতের ভাস্কর্যের আদলেই মূর্তিটি গড়া হয়েছিল। ফলত প্রতিমার পোশাকেও ছিল সেই ছোঁয়া। কিন্তু সেই যুক্তি মানতে নারাজ গেরুয়া দল। এমনিতেই নারী কী করবে, কী পরবে- এ সবকিছু নিয়েই নানা ফতোয়া দেওয়া হয় মাঝেমধ্যেই। তবে খোদ দেবীপ্রতিমাও যে সেই নীতিপুলিশির মধ্যে পড়তে পারেন, এমনটা হয়তো অনেকেই ভাবতে পারেননি। বিশেষ করে যে দেবীর প্রণামমন্ত্রেও ‘কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে’ বলা হয়, তাঁর কাঁচুলি পরা কিংবা সম্পূর্ণ দেহ আবৃত না করা নিয়ে কথা হবে, এই পরিস্থিতি কার্যত চমকেই দিয়েছে অনেককে। আর সেই বিতর্কের মধ্যেই উঠে আসছে এই প্রশ্ন, যে শাড়িকেই কেবল ভারতীয় নারীর পক্ষে শালীন পোশাক বলে দাবি করা হচ্ছে, সেই শাড়ি কি আদতে পরতেন পুরনো যুগের নারীরা? আজকের দিনে শাড়ি বলতে আমরা যা বুঝি, কোনও বস্ত্রখণ্ডকে সেভাবে জড়ানোর চল কি আদৌ ছিল প্রাচীন আমলে?
আরও শুনুন:
‘ইসলামবিরোধী’ অভিযোগে হয়েছিল নিষিদ্ধ, সেই শাড়িকে ফিরিয়ে আনছেন পাকিস্তানি নারীরা
ধারণা করা হয়ে থাকে, ‘শাড়ি’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘শাটী’ থেকে। তবে আর্যদের এ দেশে আসার আগেও এই শব্দ তথা এই পোশাকের প্রচলন ছিল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু সেই শাড়ি একটুকরো সেলাই না করা কাপড় মাত্র, যাকে যে কোনোভাবে গায়ে জড়িয়ে নেওয়া যায়। সিন্ধু বা মেহেরগড়ের মতো প্রাচীন অনার্য সভ্যতার ছবিতেও তেমনই দেখা যায়। শাড়ি সেখানে আদৌ ঊর্ধ্বাঙ্গকে সম্পূর্ণ ঢেকে রাখেনি। কোনারক-খাজুরাহোর মতো মন্দিরগাত্রের ভাস্কর্য দেখলেও এ কথার প্রমাণ মিলবে। প্রাচীন যে সব মূর্তি ভারতীয় সভ্যতার প্রতীক বলা যায়, সেগুলোর পোশাকও কিন্তু আজকের শাড়ির মতো নয়।
পরবর্তী কালে ওই একটি বস্ত্রখণ্ডকেই নানাভাবে পরার প্রচলন শুরু হয়। কেউ ঘাগরার মতো পরে সঙ্গে জুড়লেন কাঁচুলি, কেউ কুঁচি দিয়ে পরলেন, কেউ পরলেন একফেরতা করে। কেউ কেউ মনে করেন, শাড়ির আবিষ্কার আসলে করেছিলেন গরিব মেয়েরাই। যাদের ঘাগরা, কাঁচুলি, ওড়না, অধোবাস- এমন বাহারি স্তরে স্তরে পোশাক পরার সামর্থ্য ছিল না, তাঁরাই একটি কাপড়ে নিজের গোটা দেহ ঢাকার চেষ্টা করেছিলেন। সাধারণ ঘরে দীর্ঘদিন ধরে খালি গায়ে শাড়ি জড়ানোরই রেওয়াজ ছিল। ব্লাউজ তো ছিলই না, জ্যাকেট ছিল শৌখিন ব্যাপার, এমনকি সেমিজ পরলেও মনে করা হত সাহেবি ঢং।
এ কিন্তু বেশিদিন আগের নয়, মাত্র উনিশ শতকেরই কথা। ইংরেজ আমলে যাঁরা এ দেশ ঘুরে নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ফ্যানি পার্কস বলছেন এ কথা। তবে কোনও সাধারণ ঘরে নয়, রীতিমতো ধনী অভিজাত বাড়ির অন্দরমহলে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। সেই ১৮২৬ সালেও তিনি দেখেছিলেন, বাড়ির মহিলাদের পরনে সোনার জরির পাড়ের সূক্ষ্ম বেনারসী, দুই প্যাঁচে শাড়ি পরে প্রান্তটি পিঠে ফেলা। কোনও অন্তর্বাস নেই, ফলে অঙ্গের শোভা বাইরে থেকেই দৃশ্যমান। বিলেত যাওয়ার আগে ঠাকুরবাড়ির বধূ জ্ঞানদানন্দিনীও বুঝেছিলেন, সেকালে মেয়েরা যেভাবে শাড়ি পরেন তা পরে বাইরে যাওয়া অসম্ভব। সেই কারণেই দেশে ফিরে সায়া, সেমিজ ও ব্লাউজের প্রচলন করে পার্সি মেয়েদের কায়দায় তিনি শাড়ি পরা শুরু করেন, যার নাম হয় ব্রাহ্মিকা শাড়ি।
যদিও এই শোভন কায়দা নিয়েও রীতিমতো খড়্গহস্ত ছিলেন সেকালের সনাতনীরা। এমনকি ঠাকুরবাড়িতেই গগন ঠাকুরের মেয়ের বিয়ের আসরে প্রশ্ন উঠেছিল, মেয়ের গায়ে জামা কেন, সেলাই পরা জামা পরে তো কন্যা সম্প্রদান হয় না।
আরও শুনুন: ফ্যাশন নয় আন্দোলনের অংশ, সেকালে সমাদর পেয়েছিল ‘বিদ্যাসাগর পেড়ে’ শাড়ি
সুতরাং, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে, এখন শাড়ি বলতে যেমন পোশাকের কথা আমরা বুঝি, সনাতন কালে ভারতীয় মেয়েরা আদৌ তা পরতেন না। আচার্য নন্দলাল বসু সরস্বতীর যে ছবি এঁকেছেন, তা থেকেও পুরনো সময়ের পোশাকের ধরাণা মিলবে। সে ছবি অশ্লীল বলে কস্মিনকালেও কেউ বলেননি।
আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গেই বদলায় সংস্কৃতি, বদলায় পোশাক ও রুচিও। আর সেই ভিন্নমতের দাবি মেনে নিতে নিতেই পরিণত হয় সভ্যতা। কেবল নীতিবাগীশতা দিয়ে সেই ইতিহাস বদলে দিতে চাওয়া যে খুব একটা সঙ্গত নয়, সে কথা কি আদৌ বুঝবে হাল আমলের ভারত?