মা সরস্বতীকে আমরা বীণা হাতে দেখেছি ঠিকই, কিন্তু চোখের সামনে কেউ বীণা বাজাচ্ছেন, এমনটা বড় একটা দেখা যায় না। ঠিক সেখানেই একেবারে বিপরীত এক উদ্ভাসে সকলকে মাতিয়ে রেখেছেন শ্রীবাণী। একালের হয়েও তিনি বেছে নিয়েছেন চিরকালের বাদ্যযন্ত্রটিকে। আর সেকালের যন্ত্রের তারে আঙুল ছুঁইয়েই বাজাচ্ছেন একালের সুর। বাণীবন্দনার আবহে এই বীণাবাদিনীর কথাই শোনালেন চৈতালী বক্সী।
শ্বেতবসনা। বীণাপাণি। তাঁর শুদ্ধসঙ্গীতের সুরলহরীতে মুহূর্তে যেন স্তব্ধ হয়ে যায় ডিজিদুনিয়ার যাবতীয় ক্যাকোফোনি। যে পৃথিবীতে মনোযোগের গড় আয়ু মোটে কয়েক সেকেন্ড, সেখানে তাঁর সুরের মুখোমুখি বসার জন্যই শুধু দু-দণ্ড অবসর খুঁজে নিতে চায় মন। তিনি আধুনিক ডিজিটাল বিশ্বের বীণাপাণি। আমরা তাঁকে চিনি বীণা শ্রীবাণী নামে।
আরও শুনুন:
নেপথ্যের শিল্পী, উস্তাদ জাকির হুসেনের জন্য তবলা বানান যে রামচন্দ্র
বীণাপাণির চরণ ছুঁয়ে আমরা তো সেই কবে থেকেই বিভোর হয়ে আছি। তবে, সত্যি বলতে দুটো জিনিস প্রায় চোখেই পড়ে না। এক, বাগ্দেবীর মন্দির। শক্তিপীঠের দেশে তাঁর পূজা হয় বটে, তবে মন্দির তুলনায় কমই। অথচ শিক্ষাই যে শক্তি- এ তো জানা কথাই। আর, দ্বিতীয়ত যা কম দেখা যায় তা হল, বীণাবাদন। মা সরস্বতীকে আমরা বীণা হাতে দেখেছি ঠিকই, কিন্তু চোখের সামনে কেউ বীণা বাজাচ্ছেন, এমনটা বড় একটা দেখা যায় না। সরস্বতীর হাতে শোভা পেলেও, সেতার-সরোদ, সন্তুর বা গিটারের মতো জনপ্রিয়তা যেন বীণার নেই। অন্তত আধুনিক সময়ে দিকে তাকালে তেমনটাই মনে হয়। ঠিক সেখানেই একেবারে বিপরীত এক উদ্ভাসে সকলকে মাতিয়ে রেখেছেন শ্রীবাণী। একালের হয়েও তিনি বেছে নিয়েছেন চিরকালের বাদ্যযন্ত্রটিকে। আর সেকালের যন্ত্রের তারে আঙুল ছুঁইয়েই বাজাচ্ছেন একালের সুর। ঐতিহ্য আর আধুনিকতা যেন পাশাপাশি এসে বসে সেই সব মুহূর্তে। ডিজিটাল পৃথিবীতে এমনিতে প্রতি মুহূর্তে চমকের শেষ নেই। তবে শ্রীবাণীর সঙ্গীত বুঝিয়ে দেয়, তা চমকদার হয়ে উঠতে চায় না, বরং সমঝদারের আদর পেতে চায়। আর তাই বীণা হাতে তুলে নিয়েই নিয়ে তুমুল জনপ্রিয়।
বীণা কেনই-বা বেছে নিলেন শ্রীবাণী? একেবারে ভেবেচিন্তে নেওয়া পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত, নাকি আচমকাই ভালো লেগে যাওয়া যন্ত্রটিকে! শুরুটা করেছিলেন কণ্ঠসঙ্গীতেই। সুর ঠিক রাখার জন্য সেদিন পাশে ছিল বীণা। তারে তারে সুরের মায়ায় বুঝি তখনই বাঁধা পড়েছিল ছোট্ট মেয়েটি। ভালোবেসে ফেলে যন্ত্রটিকে। সঙ্গী হয় মা-বাবার উৎসাহ। দরকার শুধু একজন গুরুর। যিনি নাড়া বেঁধে শ্রীবাণীকে চিনিয়ে দেবেন সাত সুরের অলৌকিক পৃথিবী। একদিন শ্রীমতী পিচিকা সীতা মহালক্ষ্মীর দরজায় বীণা হাতে হাজির হন শ্রীবাণী। তিনিই ছিলেন শ্রীবাণীর প্রথম গুরু। সেই ৮ বছর বয়সে ২ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে বীণা শিখতে যেত ছোট্ট শ্রীবাণী। ছোট্টবেলার বন্ধুটিকে আজও তিনি ছাড়েননি। বরং আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে মোকাবিলা করেছেন পুরনো বন্ধুকে সঙ্গে নিয়েই। প্রথাগত স্নাতকের পর সঙ্গীত নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন শ্রীবাণী। বীণাবাদক হিসেবে ডিপ্লোমাও পাশ করেন। তারপর একসময় বিয়ের পর চলে আসেন হায়দরাবাদের তিরুপতি শহরে। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। তবে প্রিয় সখী বীণাটি তাঁর সঙ্গেই রয়ে গেছে। বর্তমানে যে-বীণাটি বাজান তিনি, সেটির কারুকার্যও বেশ চমকপ্রদ। তাতে আঁকা রয়েছে সৃষ্টির আদি মুহূর্ত। যেখানে ব্রহ্মার নাভিমূল থেকে বেরিয়ে আসা পদ্মে আছেন বিষ্ণু, তারের একদিকে রয়েছে সূর্য অন্যদিকে আঁকা চন্দ্র। এছাড়া রয়েছে ঐরাবত, কামধেনু-সহ নানা পৌরাণিক চরিত্র। আধুনিক করতে গিয়ে বীণার সৌন্দর্যহানি করেননি শ্রীবাণী। অথচ হালফিলের সিনেমার জনপ্রিয় গান তাঁর বীণায় বাজিয়ে নেটদুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন, নতুন দিনের সুরেও ‘বাজে গো বীণা’। দু-একটা অপ্রিয় কথা যে শোনেননি তা নয়। তিনি আধুনিকা। তাহলে আধুনিক কোনও যন্ত্রই তো বাজানোর জন্য বেছে নিতে পারতেন। এ পরামর্শ পেয়েছেন অনেকের কাছেই। শ্রীবাণী শুনেছেন সবই। আর সেই বিরুদ্ধতার স্বর থেকেই খুঁজে নিয়েছেন নিজের আগুন। বুঝেছেন, এই সব কথার জবাব যদি কেউ দেয়, তবে তাঁর বীণাই দেবে।
আরও শুনুন:
মুসলিম বাইজির প্রেমে পড়ে ধর্ম ‘ত্যাগ’ হিন্দু বাবুর! কী ঘটেছিল সেকালের কলকাতায়?
সেটা ২০১৩ সাল। শ্রীবাণীর হাতে বেজে উঠল জনপ্রিয় সব সুর। যে সব গান জনসাধারণ গাইতে-শুনতে পছন্দ করেন, বীণায় তাই-ই বাজাতে শুরু করলেন তিনি। একেবারে ধ্রুপদী ঘরানা থেকে একটু যেন সরে এসে সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলতে চাইলেন তাঁর বাদ্যযন্ত্র এবং বাদনরীতিকে। আর তাতেই হল ম্যাজিক! রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন শ্রীবাণী। তাঁর পরিচয় হয়ে উঠল, বীণা শ্রীবাণী। সবথেকে বড় কথা, জনপ্রিয় হল বীণা যন্ত্রটি। অনেক খুদে শিল্পীও বীণার তারে ঝংকার তুলতে সাহস পেল তাঁকে দেখে। শ্রীবাণী মনে করেন এটাই যেন তাঁর জীবনের সেরা প্রাপ্তি। অন্যান্য প্রাপ্তি তো তাঁর ছিলই। টানা ১৬ বছর তিনি নানা দক্ষিণী টিভি-শো সঞ্চালনার করার কাজ করেছেন। তার দরুন ২০১২ সালে বেস্ট অ্যাঙ্কর অ্যাওয়ার্ড পান। তার আগে, ১৯৯৮ সালে রাজ্য-স্তরে বীণা প্রতিযোগিতাও জিতেছিলেন শ্রীবাণী। ২১ ইঞ্চির, সবথেকে ছোট বীণা বাজানোর বিশ্বরেকর্ডও রয়েছে তাঁর দখলে। তবে, সে সবই যেন ছাপিয়ে গিয়েছে সেই মুহূর্তে যখন ছোটরা তাঁকে দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছে। যখন খানিকটা তাঁর হাত ধরেই সব সমালোচনা পিছনে ফেলে নয়া প্রজন্মের পৃথিবীতে আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে বীণা। ছোট্টবেলার সখীকে সঙ্গী করেই আজও তাই সুরের মায়া ছড়িয়ে দিচ্ছেন শ্রীবাণী। ডিজিটাল মিডিয়া অবিরল স্ক্রলের ফাঁকে হঠাৎ থমকে দিয়ে দেখে নতুন একটা গান বাজাতে শুরু করেছেন এযুগের বীণাপাণি। তাঁর মুখ উদ্ভাসিত হাসিতে। তাঁর আঙুল খেলা করে এক সেকালে যন্ত্রের শরীরে। তারের ধার হাতে লেগে জেগে ওঠে ক্ষত। তবু থামেন না তিনি। যন্ত্রণাই পারে ফুল ফোটাতে, শিল্প হয়ে উঠতে – বাণীপাণি শ্রীবাণী জানেন – এই ক্ষতের থেকে শাশ্বত এবং শিল্পিত আর বোধহয় কিছু হয় না।