রাজনীতি থেকে কবিতার দুনিয়া, মানুষের সঙ্গে জুড়ে থাকাই স্বভাব ছিল সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের। কবিতায় বলেছিলেন, ‘কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে/ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত/ যেন আমি হেঁটে যাই।’ রাস্তায় চলা মানুষের কোলাহল থেকে আলাদা হতে চাইতেন না বলে লিখতেন জানলার পাশে বসে। পথেঘাটে, বাজারে দোকানে অনর্গল গল্পে মেতে উঠতেন যে কোনও মানুষের সঙ্গে।
বাড়িতে নিয়মিত আসার সূত্রে সেই আড্ডাপ্রিয় সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখেছেন মণিমেখলা মাইতি।
কবির জন্মদিনে সেই ছবিটিই ফিরে দেখলেন তিনি।
“স্মৃতি জিনিসটা ভারি হেজলদাগড়া। একবার যেটা ধরে, কিছুতেই ছাড়তে চায় না।” রান্না করতে করতে আঁচলে হাত-মোছা-হলুদের দাগের মতোই অনেকটা থেকে যায়। তাই–
“আমার স্মৃতিতে দুলে দুলে
সারাক্ষণ
দুলে দুলে…
সারাক্ষণ আমার স্মৃতিতে
নাচছে”
সেই পুরোনো সাদা-কালো ছবিটি, বাবার সূত্রে আমাদের পারিবারিক সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। সাতের দশকে মহিষাদল রাজ কলেজের কোনও এক সাহিত্য সম্মেলনে তোলা। খুবই সাধারণ ছবি। কাঠের বেঞ্চে উপবিষ্ট কয়েকজন। তাঁদের ঘিরে রয়েছে একদল নির্বিকার মুখ। বেঞ্চে উপবিষ্ট কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্তোষকুমার ঘোষ। কিন্তু সেপিয়া রঙের ছবিটির সব আলো শুষে নিয়েছেন ঠিক মধ্যিখানে উপবিষ্ট সাদা প্যান্ট-কালো জামা, পুরু কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত ঝাঁকড়া চুলের এক ঝকঝকে, সুদর্শন মানুষ। উজ্জ্বল চোখদুটির তলায় স্বর্গীয় এক মিষ্টি হাসি।
বড়ো পছন্দের ছিল ছবিখানি। বাবা-মা গল্প করত, এঁরা সবাই আমাদের ভাড়া বাড়িতে, মাটিতে বসে সামান্য অ্যালুমিনিয়ামের থালায় মাংস-ভাত খেয়ে গিয়েছেন, আড্ডা দিয়েছেন। তখন আমি এতই ছোট ছিলাম যে, সে স্মৃতির আঁচলে হলুদের দাগ পড়েনি।
এর পর কেটে গেছে বেশ কয়েকবছর। সুকুমার রায়, করুণানিধান, সত্যেন্দ্রনাথ, কালিদাস পড়ে নিশ্চিন্তে বড় হওয়া আমি দুর্বোধ্য আধুনিক কবিতার দুর্বিপাকে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি কোন রসাতলে। আধুনিক কবিতার অক্ষর, ভাব, ভাবনা আমায় তাড়া করে বেড়াচ্ছে তখন প্রতিনিয়ত। আমি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছি কবিতা থেকে। কবিতা দেখলেই ভয় হয়, দমবন্ধ হয়ে আসে। হঠাৎই সব পালটে গেল নবম শ্রেণিতে এসে। এক আশ্চর্য কবিতা মরুভূমির বুকে যেন ভরা বর্ষা নিয়ে এল। জলের মতো সহজ ভাষায় লেখা, ভারী শব্দ ও ভাবের দমবন্ধকর অবস্থা নেই, তীক্ষ্ম শ্লেষাত্মক অথচ অদ্ভুত রকমের সাবলীল। মানুষের মুখের ভাষা যে কবিতার ভাষা হতে পারে, সেই প্রথম প্রত্যক্ষ করলুম। মুহূর্তে বড় কাছের হয়ে গেলেন তিনি। যেখানে পাই, আমি তখন শুধুই তাঁর কবিতা পড়ি। মুখে মুখে ফেরে– ‘মে-দিনের কবিতা’, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’, ‘কেন এল না’, ‘ যত দূরেই যাই’, ‘যাচ্ছি’, ‘স্বাগত,’ ‘লোকটা জানলই না’ প্রভৃতি সাড়া জাগানো কবিতা।
আমায় কবিতায় ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই সাদা-কালো ছবিটির মাঝের সুদর্শন ভদ্রলোক। ‘পদাতিক’ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। যাঁর হাজার টেসলার মতো সম্মোহনী শক্তি।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে অমিতাভ চৌধুরী একবার বলেছিলেন–
“চুরুট মুখো সুভাষ মুখো
মস্ত বড়ো কবি,
কেশর ফোলা, স্কন্ধে ঝোলা
তরুণ দলের নবি।”
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শাশ্বত রূপটি এঁকে দিয়েছেন অমিতাভ চৌধুরী এই কয়েক লাইনে। মহিষাদলে আমাদের বাড়ি ‘প্রিয়দর্শিনী’-তে তখন পদাতিক কবির আবার আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে বিভিন্ন উপলক্ষ্যে। তখন তাঁর বয়স পঁচাত্তর থেকে আশির মাঝামাঝি। চুরুট আর খান না। মাথাভর্তি সাদা কোঁকড়ানো চুলে তিনি আরও বেশি মোহময়, সুদর্শন। বাম গালের আঁচিলটি আরও যেন স্পষ্ট হয়েছে। শরীরটা আরও ভারী হয়েছে। প্যান্ট-শার্ট বিদায় দিয়ে শুধুই ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেন। আর কাঁধে সেই চিরাচরিত বিখ্যাত খদ্দরের ঝোলা। ডান হাতের কবজিতে বাঁধা ঘড়ি। যখনই আসতেন, তাঁর স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব মুহূর্তে আমাদের বাড়ির পরিবেশখানা পালটে দিত।
মনে পড়ছে ‘লম্বা মেঘের পাজামা’ পরা কবি আমার হাতখানি ধরে আস্তে আস্তে আমাদের বাড়ির দোতলায় উঠছেন। তাঁর মনের মতো তাঁর হাতখানি বড়ই পেলব। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক পা, এক পা করে উঠছি তাঁর সঙ্গে। ঠায় বসে থাকতাম তাঁর পাশে, যদি কখনও কোনও দরকার হয়। ভীষণ ভালোবাসতেন আমায়। কথা বলতেন আস্তে আস্তে, ধীরে ধীরে। আমার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতেন, বাড়ির কথা শুনতেন, সুরেলা কণ্ঠস্বর থেকে সুর ঝরে ঝরে পড়ত যেন। তাঁর অতি প্রিয় বন্ধু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো ভালো গানও গাইতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
-: আরও শুনুন :-
কবিতা মাথায় এলে আভেন নিভিয়ে লিখে নেব, বলেছিলেন দেবারতি
তিনি লিখেছিলেন–
“আমাকে কেউ কবি বলুক
আমি চাই না।
কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
যেন আমি হেঁটে যাই”
অবাক হয়ে দেখতাম এক ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ প্রাপ্ত কবি কত সাধারণ জীবনযাপন করতে পারেন। স্বল্পাহারী ছিলেন। সামান্য ভাত ডাল আলুভাজা আলুপোস্ত হলেই তাঁর চলে যেত। বেশি খেতে পারতেনও না। খাওয়াতেও ছিল তাঁর কবিতার ছোঁয়া। লম্বা লম্বা আঙুলে আস্তে আস্তে ভাত মেখে খেতেন। কত কত ছবি ভেসে উঠছে। কখনও শীতের সকালে প্রাতরাশ শেষ করে খদ্দরের চাদরখানি জড়িয়ে ‘প্রিয়দর্শিনী’-র বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন, কখনও বা জমিয়ে গল্প বাড়ির বৈঠকখানায় বা খাওয়ার টেবিলে। সঙ্গে সেই ভুবনমোহিনী হাসি। কোনও দিন শীতের হালকা রোদ্দুর গায়ে মেখে হাতে তুলে নিয়েছেন ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট। অবধারিতভাবে গীতা কাকিমার প্রসঙ্গ আসত। বারবার বলতেন– ‘গীতাকে এখানে আনতে পারলে ভালো হত। একবার গীতাকে নিয়ে আসব।’ সে আর হল কই!
-: আরও শুনুন :-
মন থেকে মনে আলো জ্বেলে চলেছেন যে নিঃশব্দ শব্দসাধক
মনে পড়ে মহিষাদলে আমাদের স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তীতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় এসেছিলেন। তাঁকে সম্মান জানিয়ে একটা নৃত্যালেক্ষ হয়েছিল তাঁর কবিতার ওপর ভিত্তি করেই। সেই কবিতাগুলির সিংহভাগ আবৃত্তি করার দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপরেই। কী উত্তেজনা ভেতরে ভেতরে। অনুষ্ঠানের কিছুক্ষণ আগে স্ক্রিপ্টটা দেখিয়ে তাঁকে প্রণাম করে এলাম। খুব খুশি হলেন। সেদিন তাঁর কলকাতা ফেরার তাড়া ছিল। এরপর কখন স্টেজ, মাইক, আলোর রোশনাইতে মজে গেলাম, খেয়াল করিনি। পরদিন সকালবেলা তাঁর সঙ্গী স্বর্গীয় মনোজ জেঠু বলেছিলেন– “মণিমেখলা, সুভাষবাবু তোর খুব প্রশংসা করে গেছেন। বারবার তোর কথা বলছিলেন।” আমি তখন আনন্দসাগরের হালকা স্রোতে তিরতির করে ভেসে চলেছি। ভাবছি, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত।’
সেই সম্ভবত শেষ দেখা তাঁর সঙ্গে। আর কোনও দিন দেখা হয়নি। কলকাতায় গেলেও তাঁর সঙ্গে দেখা করা হয়নি, সে আপশোস সারাজীবনের মতো থেকে গেছে। ‘এমন মজার খেলাঘর ছেড়ে’ তিনি চলে গেলেন ২০০৩-এ। তবে স্মৃতির মায়াজালটুকু জড়িয়ে রেখে গেলেন আমাদের ‘প্রিয়দর্শিনী’-তে আজীবনের জন্য। এখনও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই দীর্ঘ, ঋজু চেহারার, ঝাঁকড়া চুলের ‘পদাতিক’ কবি এক কিশোরীর হাত ধরে এক পা, এক পা করে এগিয়ে চলেছেন… মুখে সেই স্বর্গীয় হাসি।