ক্রমশ একাকী হয়ে পড়ছেন ভারতীয় পুরুষরা। প্রায় মহামারীর পর্যায়েই চলে গিয়েছে তা। তবু, বিষয়টি নিয়ে তেমন কথাবার্তা কি হচ্ছে? বোধহয় না। অথচ কথা বলা যে জরুরি তা স্বীকার করছেন অনেকেই। আসুন, কী বলছেন তাঁরা? শুনে নেওয়া যাক।
ভারতীয় পুরুষ কেমন হবে? ঠিক অমিতাভ বচ্চনের ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’ ইমেজের মতো। কিংবা রাজেশ খান্নার ঢঙে বলে উঠবে, ‘পুষ্পা আই হেট টিয়ারস’! পুরুষ আবার কাঁদে নাকি! পুরুষ তো পুরুষ-ই। আর এই ধারণার চাপেই ক্রমশ একাকী হয়ে পড়ছেন ভারতীয় পুরুষরা। এবং তা প্রায় মহামারির মতোই থাবা বসিয়েছে। অথচ ওই বীরপুরুষের ধারণাই তা নিয়ে যেন তেমন করে কথাবার্তা বলতে দিচ্ছে না।
আরও শুনুন: পুনম, মৃত্যু নয় ট্রেন্ডে বিকোল! মৃতদের সম্মান রক্ষা হল কি?
কথা কি একেবারে হচ্ছে না! পরিস্থিতি এমন একটা জায়গায় চলে গিয়েছে, যে, কথা না বলেও আর উপায় নেই। একটি পরিসংখ্যানের দিকে চোখ রাখা যাক। ২০২২-এর ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য বলছে, আত্মহননকারী পুরুষের সংখ্যা, মহিলাদের প্রায় দ্বিগুণ। এবং এ কোনও বিচ্ছিন্ন তথ্য নয়, বরং ধারাবাহিক ভাবেই এই সংখ্যা বাড়ছে। সন্দেহ নেই যে, পিতৃতন্ত্রের চাপ ভারতীয় নারীদের নানা ভাবেই কোণঠাসা করে রেখেছে এখনও। সেই জগদ্দল পাথর ঠেলে নারীরা একটু একটু এগিয়েও এসেছেন। তাঁদের অবস্থা, অবসাদ, একাকিত্ব নিয়ে সম্প্রতি চর্চা একটু হলেও বেড়েছে। ভারতীয় সিনেমার দিকে যদি তাকানো যায়, দেখা যাবে যে, বিগত কয়েক বছরে এই বিষয়গুলি ক্রমশ সিনেদুনিয়াতেও কেন্দ্রে উঠে এসেছে। ‘মেল গেজ’-এর বিষনজর অগ্রাহ্য করে, নারীরা নিজেদের দুনিয়া নিয়ে একটু হলেও কথা বলার পরিসর পাচ্ছেন। হয়তো প্রয়োজনের তুলনায় তা যথেষ্ট নয়, তবু কথা যে হচ্ছে, তা ভালো দিকই বলতে হবে।
এর ঠিক উলটো পিঠ হচ্ছে পুরুষের একাকিত্ব। ঘটনা হল, শুধু ভারতীয় নারীদের নয়, ভারতীয় পুরুষদেরও কোণঠাসা করে রেখেছে এই পিতৃতন্ত্রের ধারণাই। পুরুষকে ঠিক যেভাবে কল্পনা করা হয়েছে, তার চাপ বইতে বইতেই পুরুষরা ছিটকে যাচ্ছেন স্বাভাবিক জীবন থেকে। এবং সেই ধারণার বশবর্তী হয়েই, স্বীকারও করতে পারছেন না যে, এই অবসাদ বা একাকিত্ব নিয়ে কথা বল জরুরি। সাম্প্রতিক একটি ছবির উদাহরণ এখানে টানা যেতে পারে। রাজকুমার হিরানির ছবি ‘ডাঙ্কি’-তে নায়ক শাহরুখ খান সরাসরিই বলে উঠতে পারেছিলেন যে, কে বলে, ‘মর্দ কো দর্দ নেহি হোতা’? এই কথাটাই বলতে পারছেন না পুরুষরা। ফলত তলিয়ে যাচ্ছেন একাকিত্বের মহামারিতে।
আরও শুনুন: অস্ট্রেলিয়ার মন্ত্রিসভায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত, চেনেন এই আইনজীবীকে?
সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও এর একটা বড় কারণ। বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বন্ধুদের থেকে দূরে দূরে সরে গিয়েছেন ভারতীয় পুরুষরা। কাছের বন্ধু বলতে যা বোঝায়, সেরকম অন্তত ৬ জন বন্ধু কি আছেন? ভারতীয় পুরুষদের এ-প্রশ্ন করলে দেখা যাচ্ছে, বছর বছর অন্য তথ্য উঠে আসছে। এবং সংখ্যাগত ভাবে তা ক্রমশ কমতির দিকেই। বন্ধুত্বের উষ্ণতার কি অভাব বোধ করছেন? এর উত্তরে বরং হ্যাঁ-এর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তির দিকে। অর্থাৎ মনের কথা ভাগাভাগি করে নেওয়ার মতো প্রায় কেউ-ই নেই। অনেকে তো বলছেন, গান শুনতে শুনতে হাঁটা ছাড়া আর কোনও রকম সাহচর্য তাঁদের নেই। পরিস্থিতি যে জটিল তাতে সন্দেহ নেই। মুশকিল হল, ভারতীয় পুরুষদের মাথায় তাঁদের ইমেজটি এমন বীরপুরুষ গোছের তৈরি হয়ে গিয়েছে যে, তাঁরা এই একাকিত্বের জায়গাটা বুঝতে পারলেও তা নিয়ে সেভাবে আলোচনা করতে পারছে না। পিতৃতন্ত্রের হাতে তৈরি পুরুষের ধারণাই সেক্ষেত্রে সবথেকে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আগল ভেঙে বেরোতে না পারলে সমাধান নেই। আর এই মুহূর্তে সেই পদক্ষেপই একান্ত জরুরি।