জরায়ুমুখের ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে পুনম পান্ডের। আচমকা এ খবর ছড়িয়ে পড়তেই চমকে গিয়েছিল নেটদুনিয়া। ২৪ ঘণ্টা না কাটতেই তারকা নিজেই জানালেন, বেঁচে আছেন তিনি। মারণরোগ নিয়ে সচেতনতা ছড়াতেই এমন কাণ্ড করেছিলেন বলে দাবি তাঁর। কিন্তু সাফাই দিয়েও ট্রোলের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি পুনম। ট্রেন্ডি সচেতনতা ছড়াতে গিয়ে কি মারণরোগে মৃতদেরই অপমান করে বসলেন পুনম, উঠছে প্রশ্ন।
পুনম,
ছোটবেলায় গল্প শুনতেন আপনি? মা, দিদিমা, ঠাকুমার কাছে? হঠাৎ করেই ভিখারির সিংহাসনে বসে রাজা হয়ে যাওয়া, কিংবা কাঠকুড়ুনির রাজরানি হওয়ার গল্প- চিরকালের সেইসব র্যাগস টু রিচেস স্টোরি আপনিও শুনেছিলেন তো? সেইসব গল্পে সব আলোর বাইরে থাকা মানুষেরা কেমন করে ঝাঁ চকচকে আলোর নিচে এসে দাঁড়ায়, আচমকাই। উত্তরপ্রদেশের ব্রাহ্মণ পরিবারে আপনার জন্ম, তায় আবার মেয়ে। তাই কি লম্বা ঘুংঘটের আড়ালে বড় হতে হতে অমন আলো খুঁজছিলেন আপনি? যে আলো শরীরে মেখে নিলে সবাই কেবল আপনার দিকেই তাকাবে? তাই কি প্রচারে আসার জন্য, প্রচারে থাকার জন্য আপনার এত তাড়াহুড়ো? আগুপিছু না ভেবেই যে কোনও পথে পা ফেলা? নিজেই নিজের মৃত্যুর ভুয়ো খবর রটাতেও তাই আপনি দ্বিধা করলেন না, পুনম? ট্রেন্ডি সচেতনতা ছড়াতে গিয়ে যা করলেন, তাতে মারণরোগে মৃতদের আপনিই কি অপমান করে বসলেন না কোথাও?
আরও শুনুন:
স্মৃতি-বিস্মৃতি, ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট সেক্স’ আর ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা এক ‘ইমানদার’
সিন্ডারেলার গল্প শুনে থাকলেও, সত্যজিৎ রায়ের গল্প আপনি সম্ভবত জানেন না। আপনাদের সিনেদুনিয়ারই এই প্রবাদপ্রতিম পরিচালক একটা গল্প লিখেছিলেন, স্পটলাইট নিয়ে। সেখানে কী হয়েছিল, জানেন পুনম? একটিমাত্র কথা বলে সুপারস্টারের উপর থাকা যাবতীয় স্পটলাইট নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন এক বৃদ্ধ, ব্যর্থ অভিনেতা। আপনিও অভিনয়ের জগতে কোনও দিনই বিশেষ নজর কাড়তে পারেননি। কিন্তু কী দিয়ে নজর কাড়তে হয়, বাজারের চোখের সেই চাহিদা পড়তে আপনি ভুল করেননি একবারও। তাই ভারত যখন বিশ্বকাপ জয়ের দোরগোড়ায়, মিডিয়ার প্রথম থেকে শেষ হেডলাইন জুড়ে ধোনি ব্রিগেড; সেইখানে আপনি একটা কথা ভাসিয়ে দিলেন কেবল। বললেন, ভারত যদি বিশ্বকাপ জেতে, শরীরে আর সুতোটিও রাখবেন না। নগ্ন হবেন প্রকাশ্যেই। যারা আপনার নামটুকুও জানত না সেভাবে, সেদিন থেকে আপনি তাদের মাথাতেও ঢুকে পড়েছিলেন, পুনম পান্ডে! ওইটুকুই আপনার জিত, আপনার সাফল্য। শর্টকাট ছাড়া সাফল্য কি আপনিও চেয়েছিলেন, পুনম?
আপনি বলতে পারেন, রাতে কী পরে ঘুমোন, এর উত্তরে মেরিলিন মনরো-ও তো হেসে বলেছিলেন, ‘শ্যানেল নম্বর ফাইভ’। যা আদতে একটা বিখ্যাত পারফিউম মাত্র। কিন্তু শুধুমাত্র নগ্নতা দিয়ে মনরো হওয়া যায় না। ‘মাই বডি মাই চয়েস’-এর রাজনীতিও হয় না। তাই আপনি স্নানঘর থেকে লাইভ করলেন। নিজের নামে অ্যাপ বানিয়ে খুল্লমখুল্লা ব্যক্তিগত ছবি দিতে শুরু করলেন। একের পর এক বিতর্ক জুড়লেন নিজের নামের সঙ্গে। কেউ বলল আপনি ফুটেজ চান খালি, কেউ বলল আপনি নিজেই নিজেকে পণ্য করছেন, কেউ আবার আপনাকে লড়িয়ে দিতে চাইল পুরুষতন্ত্রের সঙ্গে। আপনি এসব কিছু শুনছিলেন, পুনম? নাকি বাজারের সামনে কেবল একের পর এক টোপ ফেলে চলেছিলেন আপনি? আপনি সুন্দরী, আপনি মোহময়ী, আপনি সুপারমডেল… ফ্যান ফলোয়ার আপনার ছিল না এমন নয়। কিন্ত আরও প্রচার, আরও চমক, আরও চর্চার জন্য নিত্যনতুন খবর তৈরি করেছেন আপনি। কখনও হাজতবাস করেছেন, কখনও গার্হস্থ্য হিংসার খবরে সামনে এসেছেন, আর এবার তো সবার ভাবনাচিন্তার বাইরে গিয়ে নিজের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে দিয়েছেন। তাও আবার সেই মৃত্যুর কারণ হিসেবে দাখিল করেছেন সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার বা জরায়ুমুখের ক্যান্সার, যা কেবল মেয়েদেরই হয় এবং যথেষ্ট বেশি মাত্রাতেই হয়। আপনার দাবি, নিজের মাকেও এই রোগের সঙ্গে যুঝতে দেখেছেন আপনি। তাই এই রোগ নিয়ে আপনি সচেতনতা বাড়াতে চেয়েছিলেন। আপনার মৃত্যুর খবরে পাঁচশোর বেশি প্রতিবেদন লেখা হয়েছে, আর তাতেই নাকি উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে আপনার।
আরও শুনুন:
মহিলারা যে সিনেমা ভালোবাসেন সেটাই সুপারহিট, সাফল্যের ‘সিক্রেট’ জানালেন নাসিরুদ্দিন শাহ
সত্যি, পুনম? এ কথা সেই ‘ডার্টি পিকচার’-এর সিল্ক স্মিতার মতোই শিশুসুলভ নয় কি? যিনি নিজের ছবি আর খবরওয়ালা সমস্ত পেপারকাটিং জমিয়ে রাখতেন, তাতে কী লেখা হয়েছে তা না জেনেই। আদতে সেইসব খবর জুড়েই থাকত তাঁর শরীরী বর্ণনা আর শরীর দেখানোর নিন্দা। পুনম, আপনি বাজারকে নিজের যে ভাবমূর্তি গিলিয়েছিলেন, সে বাজার আপনার খবরকে যে ওই ভাবমূর্তির সাপেক্ষেই বিক্রি করবে, তা কি আপনি জানতেন না? আপনার মৃত্যুর খবর ফের টেনে এনেছে আপনার যাবতীয় বিতর্কিত কাজ, আপনার পোশাক খোলার প্রতিশ্রুতি, আপনার বক্ষবিভাজিকা দেখানো ছবি; এসবের মধ্যে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার কোথায়, পুনম? মারণরোগের লক্ষণ চিনবেন কী করে, সে খবরও যে আপনার জলকেলির ছবিতেই বিকিয়ে গেল। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে আপনার মৃত্যু হয়েছে, এ খবরে আসলে যে ধাক্কা লাগল বাজারের ফ্যান্টাসিতেই। তাই সেই ধাক্কার পালটা আপনার বেঁচে থাকার খবর ভেসে আসতেই শুরু হল কদর্য ট্রোলের বন্যা। শুরু হল যৌনগন্ধী মিম আর কটূক্তি। আরও একবার, হারিয়ে গেল সেই মারণরোগের প্রসঙ্গটাই।
পুনম পান্ডে, আপনি ভালো করেই জানেন, সবকিছুই এখন ট্রেন্ড। কিন্তু ট্রেন্ড মানেই সবকিছু নয়। অন্তত ক্যান্সারে মরে যাওয়া রোগিণীরা, তাঁদের পরিজনেরা, তাঁদের দুঃখ-যন্ত্রণা তো নয়ই। রোগ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর নামে, আরও একবার, তাঁদের ব্যবহার করেই নিজের প্রচার কুড়োলেন আপনি। আর আপনার খেলার শর্ত মেনেই, সেই পণ্যায়নে আরও একবার শামিল হল বাজারও। আরও একবার, কিস্তিমাত করলেন আপনিই।