তিনি ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। যেমন লক্ষণীয় তাঁর সৃষ্টির স্ফূরণ, তেমনই শিক্ষণীয় তাঁর জীবনের অনুশীলন। প্যাশন এবং পেশাদারিত্বের ভারসাম্য না থাকলে এভাবে দীর্ঘদিন সৃষ্টিশীল থাকা যায় না। কী সেই রসায়ন?
শোনালেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায় এবং দেবশংকর হালদার।
শুনলেন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
একজন বড় মাপের মানুষ, তাঁর ব্যক্তিত্বের গুণেই যেন হয়ে ওঠেন আস্ত একটা পাঠশালা। তাঁর দিকে তাকিয়ে তখন আর বিস্ময়ের সীমা থাকে না। তাঁর গুণ, দক্ষতা আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে। এবার একই সঙ্গে বিস্ময় জাগায় তাঁর যাপনের বহুবিধ অনুশীলন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এমনই মহিরুহপ্রতিম ব্যক্তিত্ব।
সন্দেহাতীত ভাবেই তিনি ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা। কী সিনেমা, কী থিয়েটার- নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, যাত্রাপথে রেখে গিয়েছেন একের পর এক মাইলফলক। একই সঙ্গে তিনি নাট্য পরিচালক, সম্পাদক এবং কবি। আদ্যন্ত সাংস্কৃতিক একজন ব্যক্তি যখন দীর্ঘদিন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যান, তখন যেমন লক্ষণীয় তাঁর সৃষ্টির স্ফুরণ, তেমনই শিক্ষণীয় তাঁর জীবনের অনুশীলন। প্যাশন এবং পেশাদারিত্বের ভারসাম্য না থাকলে এভাবে দীর্ঘদিন সৃষ্টিশীল থাকা যায় না। কী সেই রসায়ন, যা তিনি আয়ত্ত করতে পারেন, অথচ যা সাধারণের অতীত?
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এই যাপন কাছ থেকেই দেখেছেন নাট্য পরিচালক দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বললেন,
প্রফেশনাল আর কমার্শিয়াল, এই দুই শব্দের ব্যাপ্তি পেশাদারিত্বকে ছুঁয়েও আসলে আলাদা। অর্থের জন্য কাজ করলেও, কাজের বিষয়ে খুঁতখুঁতে থাকেন একজন বড় শিল্পী। আর ঠিক তেমনই পারফেকশনিস্ট ছিলেন সৌমিত্র। পেশাদার রঙ্গালয়ের প্রেক্ষিতে ভাবলে দেখা যাবে, একের পর এক যে কনটেন্ট তিনি সেখানে বেছেছেন, বিদেশি নাটক থেকে শুরু করে ক্লাসিক, বিভিন্ন ধরনের নাটক- তা একমাত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেই সম্ভব হয়েছে। তিনি কেবল সেখান থেকে অর্থ উপার্জন করেই নিজের দায়িত্ব শেষ করে ফেলতে চাননি, সাধারণ রঙ্গালয়ের মান উন্নয়নের চেষ্টাও আসলে করে গিয়েছেন। আসলে পেশাদারিত্ব শব্দের অর্থটাই তাঁর কাছে আলাদা ছিল। মেকআপ থেকে কস্টিউম, প্রতিটি বিষয় নিয়েই এই খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস ছিল তাঁর। একজন অভিনেতা যে কখনোই তৃপ্ত হয় না, তিনি ছিলেন ঠিক তেমনটাই। অভিনয়ের শেষে জিজ্ঞাসা করতেন, কেমন লাগল? দুবার একই নাটক দেখলে প্রশ্ন আসত, আগেরবারের থেকে কি কোনও ফারাক খুঁজে পেলে? তিনি জানেন তিনি কী করছেন, তবুও একজন সাধারণ দর্শকের কাছেও এই প্রশ্ন রাখতে পারতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
পেশাদার সৌমিত্র ঠিক কোন জায়গায় স্বতন্ত্র, সেই কথাই জানালেন অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। বললেন,
অত বড় স্টার, মহানায়ক বলা যায়, অথচ কোনও দিন কোথাও দেখিনি দেরি করে যেতে। সবসময়েই আগে যেতেন, এবং দেরি হলে বিরক্ত হতেন। আর এমনই পেশাদার যে, যখন ওঁর কিউ নেই, অনেকক্ষণ পর মঞ্চে ঢোকার কথা, তখনও উইং-এর ধারে বসে আছেন। অন্যদের অভিনয় দেখছেন। অর্থাৎ আমি আজ নাটকের কাজে এসেছি মানে পুরো সময়টাই এখানে থাকব, যখন আমার ভূমিকা নেই তখনও। আমি ওঁর জুনিয়র, আমারও অভিনয় দেখতেন। দলের অন্যান্যদের অভিনয়ও। সমালোচনা নয়, শুধু দেখা। এই যে নাটকটার মধ্যে থাকা, আমি একেই বলি পেশাদারিত্ব। এই কাজটায় আমি সম্পূর্ণ করে আমাকে দিলাম, এমনটা করতে পারতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
গুণীর গান আমাদের অবাক করে। আর সেই অবাক-পৃথিবী পেরোলে খেয়াল হয়, তার মধ্যে মিশে আছে কতখানি নিষ্ঠা, বিনয়, সম্ভ্রম আর অন্তরের শক্তি। সৃষ্টি ও সাফল্যের এই পথ যিনি দেখাতে পারেন, তিনিই বরণীয় হয়ে ওঠেন উত্তরকালে, ঠিক যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
জীবনের শিক্ষাতেই প্রতিদিন যেন হয়ে ওঠেন প্রকৃত শিক্ষক।