বিজ্ঞানের মেধাবী তরুণ রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যা এখনও আমূল নাড়িয়ে দেয় দেশের আত্মা। দলিত তরুণের শেষ চিঠিটি আমাদের বিপন্ন করে। প্রশ্নের মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়। সাত বছর পেরিয়েও তাই সে চিঠির প্রাসঙ্গিকতা ফুরোয় না।
রোহিতের চিঠিটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন পার্থ বসু।
আত্মহত্যা করেছিলেন অন্ধ্রের হায়দরাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র, গবেষক রোহিত ভেমুলা। এই পোড়া দেশে ফি বছর এমন অজস্র আত্মহননের খবর কাগজে আসে। এইসব তরুণ কেউ প্রেমে, কেউ উচ্চাশার বা পরিবেশের চাপে, অবসাদে, কেউ বা ড্রাগ এর নেশায় বেপথু হয়ে, আরও নানান কারণে এমন কাণ্ড বাঁধিয়ে বসেন। রোহিতের মৃত্যু তাহলে কোথায় আলাদা?
রোহিতের জন্ম পরিচয়েই আছে সেই উত্তর। তিনি দলিত। এমন দাবিও উঠেছিল যে, রোহিত পিছড়ে বর্গের ভাদেরা সম্প্রদায়ের। আদৌ দলিত নয়। চেষ্টা চলেছে তাঁর মৃত্যুর তাৎপর্য লঘু করে দেখানোর। তবে, রোহিতের মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে সাতটা বছর। এখনও তাঁর শেষ চিঠিটি আমাদের যেন অন্য এক ভারতবর্ষের মুখোমুখি এনেই দাঁড় করিয়ে দেয়। চিঠিটির অনুবাদ করেছিলেন কবি পার্থ বসু।
রোহিতের চিরকুট
এ চিঠি যখন তোমাদের হাতে পড়বে আমি তার আগেই নেই হয়ে গেছি। রাগ কোরো না। জানি, তোমরা কেউ কেউ আমায় ভালোবাসতে, ভালো ব্যবহার করতে, যত্ন নিতে। কারও বিরুদ্ধে কোন নালিশ নেই আমার। আমার সমস্যা ছিল আমাকে নিয়ে। এইমাত্র। আমার শরীর ও সত্তার মধ্যে মাথা চাড়া দিচ্ছিল যে দেওয়াল, যে দূরত্ব তার পরিণামে আমি এমন অদ্ভুত।
আমার সব সময়ের স্বপ্ন ছিল লেখক হওয়ার। বিজ্ঞান লেখক। কার্ল সাগানের মতো। শেষ অব্দি লিখছি। একটাই চিঠি। শেষ পত্র।
বিজ্ঞান, নক্ষত্রলোক আর প্রকৃতি নিয়ে আমার ভালোবাসার ভুবন। মানুষকেও ভালোবাসা দিতে গেলাম। একসময়। মানুষ যে প্রকৃতির কোল থেকে নির্বাসিত, সে কবেই, জানাই ছিল না। তার অনুভব হাতফেরতা। তার ভালোবাসা নির্মাণসাপেক্ষ। তার বিশ্বাসে রঙের পরত। তবু বৈধ তার ভালোবেসে কষ্ট না পাওয়ার আদিম আকাঙ্ক্ষাটুকু।
মানুষের মূল্য নামতে নামতে চড়ায় ঠেকেছে। তাই সে এখানে বা যেখানে যখন। যতটা সম্ভব। সে কখনও একটি ভোট। একটি নিছক সংখ্যা। বস্তু মাত্র। জীবনের নানা পর্বপরিক্রমা, পাঠে কিংবা পথে, রাজনীতিতে, জীবনে মরণে।
এমন একটি চিঠি জীবনে প্রথম লিখছি। এই শেষ। শেষবারের মতো। যদি নিরর্থক লাগে, মাফ চাইছি।
হতে পারে আমারই বোঝার ভুল। ভুল আমার।ভুল বুঝেছি পৃথিবীকে। ভুল বুঝেছি ভালোবাসা, বেদনা ও জীবন মৃত্যুকেও। এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল না হয়তো। আমি কিন্তু মরিয়া ছিলাম জীবনের পিঠে চড়ব কবে। কারও কারও কাছে জীবন মানেই একটি অভিশাপ। যেমন আমার জন্ম। একটি ভয়ানক দুর্ঘটনা। আশৈশব একাকীত্ব থেকে অনাদরক্লিষ্ট শিশু মুক্তিই পেল না।
মানুষ আমার নামে ভীতু শব্দটি দেগে দেবে। স্বার্থপর, মূর্খ বলবে কেউ কেউ। পরোয়া করি না। চলে গেলে আমার কি যায় আসে তাতে? মরার পরের গল্পে, ভূত প্রেতে বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করবই যদি বরং বিশ্বাস করব ছায়া থেকে আমি তারায় সফর করব। হে বন্ধু, বিদায়!
দুঃখিত উমা আম্মা। এই কর্মটির জন্য তোমার ঘরটি ব্যবহার করলাম। এএসএ-( আম্বেদকর ছাত্র সংগঠন), এই পরিবারের সবাইকে হতাশ করলাম। দুঃখিত।
ভীষণ ভীষণ ভালোবাসতে আমাকে তোমরা। আগামীর জন্য অনেক শুভেচ্ছা রইল।
শেষবারের মতো বলি- জয় ভীম!
প্রথামতো আরও কিছু লিখতে হয়। ভুলে গিয়েছিলাম। আমার এই আত্মহত্যার জন্য কেউ দায়ী নন। কোথায় বা কাজে কেউ কোন উস্কানি দেননি।আমার মৃত্যুর পর
আমার মিত্র বা শত্রু চাই না কেউ ঝঞ্ঝাটে পড়ুন।
ঐকান্তিক
রোহিত ভেমুলা
১৭/০১/২০১৬