মতি নন্দী শিখিয়ে গেছেন খেলা নিয়ে লেখা মানেই লেখা নিয়ে খেলা নয়। একজন সাহিত্যিকের কলম, একজন পাঠকের দৃষ্টি আর একজন ক্রীড়াবিশ্লেষকের মগজের নিখুঁত ব্যালেন্সই জন্ম দিতে পারে একটি সার্থক ক্রীড়াসাহিত্যের। মতি নন্দী দর্শকদের ভেতরে এক চিরন্তন খেলোয়াড় সত্তা বুনে গিয়েছেন তাঁর গল্পে-উপন্যাসে, আর তাঁর কলমে থেকেছে নিখুঁত ব্যালেন্স। লেখকের প্রয়াণ দিবসে সেই ব্যালেন্সের গল্প শোনালেন অর্পণ গুপ্ত।
ব্যালেন্স, কমল, ব্যালেন্স কখনও হারাসনি। আমি ব্যালেন্স রাখতে পারিনি তাই কিছুই রেখে যেতে পারছি না, একমাত্র তোকে ছাড়া…
স্টপার, মতি নন্দী
ক্রীড়াসাহিত্য শব্দবন্ধটিকে ভাঙলে দুটি শব্দ পাওয়া যায়, ক্রীড়া এবং সাহিত্য। এই দুই শব্দ পিঠ চাপড়ানো বন্ধুতা দেখিয়ে পাশাপাশি বসলেও আদতে পরস্পরবিরোধী। অন্তত বর্তমানে ক্রীড়াসাহিত্য বিষয়ক যে কোনও আলোচনায় একপক্ষে ক্রীড়াবিশ্লেষক, অন্যপক্ষে সাহিত্যিকদের বসালে বিষয়টা তেমনই দাঁড়ায়। এক পক্ষের মতে, সাহিত্যের ভেতর ক্রীড়া-ই না থাকলে তা ক্রীড়াসাহিত্য নয়, অন্য পক্ষ বলেন ক্রীড়ার ভেতর সাহিত্য না থাকলে তা সাহিত্যের সূচকে নিছকই অর্থহীন। মতি নন্দী শিখিয়ে গেছেন খেলা নিয়ে লেখা মানেই লেখা নিয়ে খেলা নয়- একজন সাহিত্যিকের কলম, একজন পাঠকের দৃষ্টি আর একজন ক্রীড়াবিশ্লেষকের মগজের নিখুঁত ব্যালেন্সই জন্ম দিতে পারে একটি সার্থক ক্রীড়াসাহিত্যের। তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘স্টপারে’ কমল গুহ-কে তাঁর গুরু পল্টুদা বলেছিলেন, ‘এই পৃথিবীটা ঘুরছে ব্যালেন্সের ওপর। মানুষ হাঁটে ব্যালেন্সে, দৌড়য়, ড্রিবল করে, এমনকী মানুষের মনও রয়েছে ব্যালেন্সের ওপর। চালচলনে, ব্যবহারে ও চিন্তাধারায় কখনও ব্যালান্স হারাসনি…’। ঠিক সেই কথার মতোই, মতি নন্দী মৃত্যুর চোদ্দ বছর পরেও যেন বাঙালি পাঠক ও লেখকদের সাহিত্য ও ক্রীড়ার ব্যালেন্সের পাঠটি দিয়ে চলেছেন।
ননীদা নট আউট উপন্যাসের একটি অংশের দিকে চোখ রাখা যাক-
‘নিজের ৪৮ রানে পৌঁছে তন্ময় গ্লান্স করেই দৌড়ল দুটি রান নিয়ে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করবে বলে। দৌড়বার আগে লক্ষই করেনি শর্ট স্কোয়্যারলেগ বল থেকে কতটা দূরে। তন্ময় তখন পিচের মাঝামাঝি, ননীদা ওকে ফেরত যাবার জন্য চিৎকার করছেন। তন্ময় ফিরে তাকিয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। আর কিছু করার নেই তার। স্কোয়্যার লেগের ছোঁড়া বল উইকেটকিপার ধরেছে। তন্ময় চোখ বন্ধ করে ফেলল…’
এর ঠিক পরের অংশে মতি নন্দী লিখছেন-
‘ক্রিকেটে অসাবধান হলেও যেমন মৃত্যু আছে, তেমনই আত্মহত্যাও আছে। সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি করে এখন আমার হবেটা কী? তার থেকে যার ভবিষ্যৎ আছে, সে খেলুক।’
এখানে লক্ষণীয়, একই উপন্যাসের দুটি অংশে একদিকে লিখিত হয়ে থাকছে ক্রীড়াসাংবাদিক মতি নন্দীর নিখুঁত গেম প্ল্যানিং-এর মাধ্যমে একটি ক্রিকেট ম্যাচের স্লগ ওভারের খেলা, সাতের দশকের ঝিরঝিরে সাদাকালো টেলিভিশনে দর্শক যেন প্রত্যক্ষ করছেন একটি শর্ট মিড উইকেটের থ্রো থেকে হওয়া রান আউট। অন্যদিকে দ্বিতীয় অংশে, চিরকালীন ক্রিকেটপাগল ননীদা, নিজের উইকেটটি ছুড়ে দিয়ে আসছেন তাঁর শিষ্য তন্ময়কে বাঁচাতে। ক্রীড়াপ্রেমী পাঠককে একবার মতি নন্দী নিয়ে যাচ্ছেন ময়দানে, নিজের চোখ দিয়ে দেখাচ্ছেন ক্রিকেট ম্যাচ, আবার পরের অংশেই জীবনের আদি-অকৃত্রিম ঘরে ফেরার রুটের বাসটিতে চেপে বসছেন চিনেবাদাম চিবোতে চিবোতে- পাঠকের মননে ছাপ পড়ছে এক জীবনদর্শনের, যার মূল সুরটি তখনও থেকে গেছে ময়দানে, খেলায়।
আরও শুনুন: সুমন যেন অমোঘ সংক্রমণ, বাঙালিকে আধুনিক উচ্চারণে বলতে শেখালেন ‘তোমাকে চাই’
উত্তর কলকাতার অলিগলিতে জীবনের বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়ে ফেলা মতি নন্দীর লেখায় যে পরিবেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, যে মধ্যবিত্ত জীবনের সঙ্গে অলস মোলাকাত- তাঁর উপন্যাসের চরিত্রের ভেতর সেই দেখা না-দেখা জীবনের ক্রাইসিসের ছায়া পড়ে। আমরা দেখি, একটি উপন্যাসে আচমকা নায়ক চরিত্রের পাশ থেকে এক অতি সামান্য চরিত্র তার ক্রাইসিসের স্বকীয়তায় কিছুক্ষণের জন্য নায়ক হয়ে যায়। মতি নন্দী উদযাপন করেন এই আন্ডারডগের উত্থানকে। তাঁর খেলার উপন্যাসের স্বাতন্ত্র্যের এক বড় কারণ তাঁর কলমে থাকা এই জাদুকাঠিটি। স্টপারে শোভাবাজার – যুগের যাত্রী ফাইনাল ম্যাচের আগে টিম মিটিংয়ে কমল গুহ-কে বলা শম্ভুর কথাগুলো মনে পড়ে?
‘আমি পালাব? আমি পালিয়ে যেতে চাই? আমার বাপ দেশভাগ হতে পালিয়ে এসেছিল। শেয়ালদার প্ল্যাটফর্মে আমি জন্মেছি কমলদা, আমার মা মরেছে উপোস দিয়ে, বড় ভাই মরেছে খাদ্য আন্দোলনে গুলি খেয়ে। আমি চুরিচামারি অনেক করেছি, আজ ছিঁড়ে খাব সবাইকে।’
খেলা নিয়ে লেখা মানেই ছেলেখেলা নয়-এর যে বিশ্বাস মতি নন্দীর, তা তিনি লালন করেছেন তাঁর উপন্যাসের ছত্রে ছত্রে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়ানায়কদের তিনি এনে ফেলেছেন বাংলা সাহিত্যে। তবে কেবলই কি এনে ফেলা? সে কাজ তো চার দশক ধরে ক্রীড়াসাংবাদিক মতি নন্দী করেই গিয়েছেন সংবাদপত্রের পাতায়। উপন্যাসের ক্ষেত্রে এই চরিত্রদের নিয়ে আসার আসল মুনশিয়ানা তাঁদের বাঙালিয়ানার বহমান নদীটিতে ডুবিয়ে নেওয়ায়। কিংবদন্তি এমিল জ্যাটোপেক এসেছেন ধান্যকুড়িয়ার নারানের ভেতর। এমিল জ্যাটোপেককে বাঙালি একবার চিনেছে সংবাদপত্রের পাতায়, আর ‘নারান’ উপন্যাসে বাঙালি জ্যাটোপেককে আঁকড়ে ধরছে নারানের চোখ দিয়ে। সাত-আটের দশকের ছবির মতো কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার ভেতর সারাজীবন কাটানো নারান যখন জ্যাটোপেককে চোখের দেখাটুকু দেখার আশায় সারারাত জেগে, ট্রেনে চেপে কলকাতা এসে, কয়েক মাইল দৌড়েও তাঁর সাক্ষাৎ পায় না, তখন জ্যাটোপেকের দূরদ্বীপবাসী সত্তাটির পাশে সজীব হয়ে ওঠে নারানের সাদামাটা জীবনখানি। সজীব হয়ে ওঠে সমস্ত মধ্যবিত্তের না-পাওয়া স্বপ্নেরা, মতি নন্দীর ‘নারান’ উপন্যাসের শেষ লাইনে বলে ওঠে-
‘এইটুকু দৌড়তে পারব না! যতদিন পারি হুশ হুশ করে আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলব…’
‘অপরাজিত আনন্দ’ উপন্যাসে কেন রোজওয়াল হতে চাওয়া আনন্দের ভেতরে যেভাবে থেকে যায় এক টুকরো রোজওয়াল, আর মতি নন্দী সেই অমোঘ থেকে যাওয়াটুকুকেই নিয়ে চলে আসেন তাঁর উপন্যাসের মোক্ষম অংশে, বাঙালি পাঠক রোজওয়ালকে টেনিসের কোর্টে চেনার আগে চিনে নেয় অপরাজিত আনন্দের শেষ ছত্রে।
‘সারা পৃথিবী জুড়ে খেলা চলেছে রোজওয়াল, তুমি কি কাগজ পড়ো না? দ্যাখো না রোজ কত জায়গায় কত খেলা? অফুরন্ত, অগুন্তি। আমি এই বিছানায় শুয়ে একটার পর একটা খেলা খেলে যাব। শেষ সুযোগ সবসময় আমার সামনে থাকবে- চিরকাল। সারা পৃথিবী গ্যালারিতে বসে অপেক্ষা করে থাকবে আমাদের ফাইনাল খেলাটার জন্য।’
এখানে সাহিত্যিক মতি নন্দীর ভেতর সূক্ষ্মভাবে অবস্থান করছেন একজন সাংবাদিক মতি নন্দী- যাঁর অবাধ যাতায়াত আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামানচিত্রের সমস্ত দিকে। মতি নন্দী এখানেই হয়ে ওঠেন তাঁর নিজের উপন্যাসেরই চরিত্র; কমল গুহ- জীবনে ব্যালান্সের সামান্যতম ভুলচুকও বরদাস্ত করেন না যিনি। ‘শিবার ফিরে আসা’-র মতো প্রবল জনপ্রিয় উপন্যাসে একদিকে যেমন বক্সিং-এ শিবার ফুটওয়ার্ক, তাঁর লেফট হুক-কে ব্যাখ্যা করছেন, তেমনই বারবার হেরে যাওয়া মানুষের শেষবার ফিরে আসতে চাওয়ার লড়াইটিকেও ধরছেন বহু যত্নে।
“শিবার মনে হচ্ছিল, আবার নতুন করে যেন সে জন্মাচ্ছে। এইবার সে কেঁদে উঠবে। মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়ে বাচ্চা যেমন করে কেঁদে ওঠে, সেইভাবে কান্না তার গলায় উঠে আসছিল। সে তখন মনে মনে বলছিল, ‘আমি ফিরব, ফিরে আসব, আবার আমি রিং-এ উঠব’।”
সাহিত্যিক মতি নন্দীকে নিয়ে একবার জয় গোস্বামী বলেছিলেন- ‘মতি নন্দী তাঁর লেখার ভেতর চরিত্রদের নিয়ে এসে তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতেন। নিখুঁত বাস্তব অথচ খানিকটা অভাবনীয় অবস্থার মধ্যে তাদের নিয়ে গিয়ে ফেলতেন। তারপর লেখক হিসেবে যেন পর্যবেক্ষণ করতেন একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।’
মতি নন্দীর চরিত্রদের মধ্যে খেলা আছে। তাঁর আজন্ম বিশ্বাসে যে খেলা, যে পরিস্থিতির দুর্লঙ্ঘ্য সুতোয় মানুষের পুতুলনাচ- জীবনের সেইসব আবহমান ঘটনাকে মতি নন্দী বসিয়ে দিয়েছেন ময়দানে, কিংবা ময়দানের সবুজকে লাগিয়ে দিয়েছেন এইসব সাদাকালো জীবনে- একেবারে পরস্পর মুখোমুখি দুটি ট্রানজিশন তাঁর লেখায়। এই লেখনী এসেছে তাঁর অক্ষরের প্রতি যত্ন থেকে, তাঁর খেলার প্রতি নির্মোহ দৃষ্টি থেকে আর সর্বোপরি লেখক হিসেবে নিজেকে একবার দর্শকাসনে বসিয়ে, মনের গহিনে নিজেকে ময়দানের অংশ ভেবে মাঠে নেমে পড়ার অধ্যবসায় থেকে। খেলোয়াড়ের অবসর হয়, কিন্তু দর্শকের তো ছুটি নেই। মতি নন্দী দর্শকদের ভেতরে এক চিরন্তন খেলোয়াড় সত্তা বুনে গিয়েছেন তাঁর গল্পে-উপন্যাসে, কলমে থেকেছে নিখুঁত ব্যালেন্স, আজকের ফিকশনাল ক্রীড়াসাহিত্যে যা টেমপ্লেট হিসেবে বিবেচিত হতে পারে নির্দ্বিধায়…