হিন্দু সমাজের মাথাদের একজন তিনি। অথচ তিনিই খেপে উঠেছিলেন এক মুসলিম তরুণীকে বিয়ে করার জন্য। তাও আবার যে কেউ নন, তরুণী পেশায় বাইজি। দুই ভিনধর্মের মানুষের এই ভালবাসার গল্পকে ধরে রেখেছে সেকালের কলকাতা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
ভিনধর্মের কারও সঙ্গে প্রেম! তার মানেই তো জাত গেল! হ্যাঁ, এ যুগেই যখন দুই আলাদা জাত ধর্মের মানুষের মধ্যে মেলামেশা বাড়লে তা নিয়ে এত কথা উঠছে, সে যুগে তো তা নিয়ে গেল গেল পড়বেই। তেমনটাই ঘটেছিল, যখন এক মুসলিম তরুণীর প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে তাকে একেবারে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন কলকাতার এক ধনী বাবু। শুধু তাই নয়, প্রেমের জোয়ারে ভেসে নিজেও ইসলামি আদবকায়দা মানতে শুরু করেছিলেন তিনি, গায়েও চড়াতেন ইসলামি ধাঁচের পোশাক। তিনি ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন কি না, এমন সংশয়ও রয়েছে। আর এই ঘটনা নিয়েই রীতিমতো শোরগোল পড়ে গিয়েছিল সেকেলে কলকাতার সমাজে।
আরও শুনুন: বিকিনি আর ঘাসের ঘাগরায় হিল্লোল মিস শেফালির, পার্ক স্ট্রিটের রাতে নেশা জমাত ক্যাবারে
সময়টা উনিশ শতক। সে কলকাতার গায়ে তখনও লেগে রয়েছে অনেকখানি সংস্কার, আচারবিচার, ছোঁয়াছুঁয়ির রীতিনীতি। সে কলকাতা ঢিমে তালে চলে, সেখানে পান থেকে চুন খসলে তা নিয়ে বিচার বসান সমাজপতিরা। তেমনই এক কাণ্ড ঘটেছিল হাটখোলার দত্ত পরিবারের বংশধর কালীপ্রসাদ দত্তকে নিয়ে। যাকে কলকাতার পুরোনো কথা মনে রেখেছে ‘কালীপ্রসাদী হ্যাঙ্গাম’ বলে।
ইংরেজ আমল শুরু হওয়ার পর শহরে অনেকের হাতেই প্রচুর পরিমাণে বাড়তি ধনদৌলত এসে পড়েছিল সেসময়ে। দত্ত পরিবার সেই ধনীগোষ্ঠীগুলির মধ্যে অন্যতম। আর সেকালে ধনীদের মধ্যে রক্ষিতা রাখাটাই চল। কার কতজন বাঁধা বেশ্যা রয়েছে, আর সেখানে আমোদপ্রমোদ করতে গিয়ে বাবু কী পরিমাণ টাকা ওড়াচ্ছেন, তা দিয়ে ধনীদের দর বাড়ত সেকালে। কিন্তু এই সবটাই চলত বাড়ির বাইরে। বাগানবাড়িতে যাই হয়ে যাক, মূল বাড়িতে কোনও রক্ষিতাকে নিয়ে আসার প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু বাবুদের এই ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ স্বভাবকেই সপাটে উড়িয়ে দিয়েছিলেন দত্তবাবু কালীপ্রসাদ। জানা যায়, কালীপ্রসাদের একজন রক্ষিতা ছিলেন, যার নাম আনার বা আনারো বিবি। একসময় তাঁকে নিজের বেলেঘাটার বসতবাড়িতেই নিয়ে আসেন কালীপ্রসাদ। এক দম্পতির মতোই একসঙ্গে থাকতে শুরু করেন যুগলে। কালীপ্রসাদ ক্রমশ মুসলিম ঘরানার পোশাকআশাক পরতে শুরু করেন। শোনা যায়, গোমাংসও খেতেন তিনি, সেসময়ের হিন্দুরা যাকে জাতিনাশ বলেই মনে করত।
এই আনারো বিবি কে ছিলেন, তা অবশ্য খুব বিশদে জানা যায় না। কেউ কেউ বলেন, তিনি লখনউ থেকে এসেছিলেন বাংলায়। সাধারণ বেশ্যাদের সঙ্গে লখনউয়ের বাইজিদের একটা বড় তফাত ছিল। এঁরা নাচ-গান-বাজনায় চূড়ান্ত পটু ছিলেন, কেবল দেহব্যবসাই এঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু কোনও নারী কী পারেন, কী তাঁর গুণ, তা নিয়ে সমাজ আর কবেই বা মাথা ঘামিয়েছে! মুসলিম মহিলা, তায় বাইজি, তাঁর সঙ্গে এক বনেদি হিন্দু পুরুষ সহবাস করছেন, এটুকুই যথেষ্ট ছিল কলকাতার হিন্দু সমাজে নিন্দার ঝড় তুলে দেওয়ার জন্য। ১৮৩৪ সালের ৫ই এপ্রিল, বাংলা সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ জানায়, জনৈক বিশিষ্ট বাঙালি হিন্দু আনারো বিবিকে বিবাহ করার জন্য ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এবং ইজ্জত আলি খান নাম গ্রহণ করেছিলেন। সমস্ত সম্ভাবনা বিচার করে বলতে হয় ইজ্জত আলি খান কালীপ্রসাদ ছাড়া কেউ নন। এই কেচ্ছার জেরে তাঁকে কার্যত একঘরে করে দেয় সেকালের অভিজাত সমাজ।
আরও শুনুন: স্তনে-নখে মাখানো বিষ, সম্মোহনে সুন্দরী বিষকন্যাকে স্পর্শ মাত্র মৃত্যু অবধারিত পুরুষের
এমনিতে সেকালের কলকাতার গল্পে কান পাতলেই শোনা যায় কেচ্ছার টুকরোটাকরা। সেসব কিস্সার বেশিরভাগেরই কেন্দ্রে রয়েছে নর-নারীর সম্পর্ক। আর সেইসব কিস্সা কেলেঙ্কারির পুরোভাগেই রয়েছে এই কালীপ্রসাদি হ্যাঙ্গামের কথা। মনে করা হয়, কালীঘাট মন্দিরের সঙ্গেও একরকম যোগাযোগ রয়েছে এই কালীপ্রসাদি হ্যাঙ্গামের।
তবে সমাজে, সংবাদে এই ঘটনা নিয়ে যতই তোলপাড় চলুক, কালীপ্রসাদ তাতে বিশেষ মাথা ঘামাননি। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটল তাঁর মাতৃবিয়োগ। আর এইবারেই দত্তবাবুকে বাগে পেলেন অন্য ধনী বাঙালিরা। হিন্দু সমাজের মাথারা, বিশেষ করে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের ছেলে রাধাকান্ত দেব ফতোয়া জারি করে দিলেন, জাতিচ্যুত কালীপ্রসাদের মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাবে না কোনও ব্রাহ্মণই। কালীপ্রসাদ নিজে ধর্ম নিয়ে মাথা নাহয় নাই ঘামালেন, কিন্তু মায়ের শ্রাদ্ধ বলে কথা! এদিকে ব্রাহ্মণ ছাড়া সে কাজ হওয়ারও জো নেই। শেষ পর্যন্ত তাঁর সহায় হলেন আরেক ধনী ব্যবসায়ী রামদুলাল সরকার। হাটখোলার দত্ত পরিবারে বাজার সরকারের কাজ করা রামদুলাল ততদিনে ধনী সমাজে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছেন। কালীপ্রসাদ আর রামদুলালের যৌথ উদ্যোগে তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালেন সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার, যাঁরা শোভাবাজারের দেব পরিবারের ঘোরতর প্রতিদ্বন্দ্বী। সাবর্ণ-কর্তা সন্তোষ রায়চৌধুরীর অনুগত ব্রাহ্মণদের নিয়ে শেষমেশ সম্পন্ন হল শ্রাদ্ধ। এবার ব্রাহ্মণদের তো দক্ষিণা দিতে হয়। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নাকি ২৫ হাজার টাকা দক্ষিণা দিতে চেয়েছিলেন কালীপ্রসাদ। কিন্ত সন্তোষ রায় কালীপ্রসাদকে বোঝালেন, এই দক্ষিণা নিলে রাজা নবকৃষ্ণের তরফে রটানো হবে যে, টাকা দিয়ে বড়িশার হিন্দুদের কিনেছেন কালীপ্রসাদ। শেষ পর্যন্ত কালীঘাট মাতৃমন্দিরের নির্মাণের কাজে দান করা হয় ওই বিপুল অর্থ। বর্তমান মন্দির ভবনটি তৈরি হতে যে ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল, তার ২৫ হাজার টাকাই এসেছিল কালীপ্রসাদের অনুদান থেকে।
এদিকে কালীপ্রসাদ তাঁর বেলেঘাটার বসতবাড়ি, যেখানে তিনি আনারোর সঙ্গে বসবাস করতেন, তা আনারোর নামেই উইল করে দিয়েছিলেন। কালীপ্রসাদের মৃত্যুর পর আনারো বিয়ে করেন মুন্সী আমিরকে, যাঁর নামে বেলেঘাটায় এখন মুন্সীবাজার। তবে হাতবদল হয়ে কালীপ্রসাদের সেই বাগানবাড়ি এখন সরকারের হাতে। একদিন যে কেচ্ছা নিয়ে কলকাতার বাঙালি সমাজে গেল গেল রব পড়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই সমাজ থেকে মুছেই গিয়েছে কালীপ্রসাদ দত্ত কিংবা আনার বিবির নাম।