বাজারের সব মোয়াই নাকি জয়নগরের! সে তার সাকিন-ঠিকানা যা-ই হোক না কেন, জয়নগরের মোয়া যেন যে কোনও মোয়ার সর্বজনীন পরিচয়। এদিকে মোয়ার তো আধার কার্ড হয় না। তাহলে আসল-নকল চেনা যাবে কী উপায়ে? মোয়াশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে তারই খোঁজ পেলেন শুভদীপ রায়।
ক্যালেন্ডারের শেষ পাতা। ডাইনিং টেবিলে কমলালেবুর খোসা। চেয়ারে ভাঁজ করা শাল, সোয়েটার কিংবা হনুমান টুপি। আর ফ্রিজের মাথায় রাখার মোয়ার প্যাকেট। শুধু মোয়া বললে ভুল হয়, প্যাকেটের গায়ে বড় হরফে লেখা ‘জয়নগরের মোয়া’। শীতকালে বাঙালি বাড়ির অন্দরমহলে এসব না থাকলে ঠিক যেন মানায় না।
আরও শুনুন: বড়দিন, কেক, যিশুর গান
এবার কমলালেবু, সোয়েটার কিংবা হনুমান টুপির তো আসল নকল বোঝার তেমন ব্যাপার নেই। কিন্তু ‘জয়নগর মোয়া’, তার তো আসল-নকল হতেই পারে। বলা ভালো, হয়ও। যা বাইরে থেকে দেখে এতটুকু বোঝার উপায় নেই। কারণ সব মোয়ার প্যাকেটেই বড় বড় করে লেখা ‘জয়নগরের মোয়া’। তাই আসল মোয়া চিনতে হলে প্যাকেট খোলা ছাড়া উপায় নেই। সেক্ষেত্রেও কয়েকটা ব্যাপার না জানলে মোয়া চেনা মুশকিল। আসলে, শক্তিগড়ের ল্যাংচা, বর্ধমানের মিহিদানার মতোই মোয়ার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জয়নগরের নাম। বর্তমানে শুধুমাত্র বাঙালির প্লেটে নয়, শীত পড়লেই দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে যায় ‘জয়নগরের মোয়া’। এর কারণও রয়েছে একাধিক। প্রথমে বলতে হয় মোয়া তৈরির মূল উপাদানের কথা। ঠিক ধরেছেন, বিশেষ এক খই যা কনকচূড় ধান থেকে তৈরি, তার কথাই বলছি। এই খই স্রেফ ওই অঞ্চলেই পাওয়া যায়। সরকারি জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর, এই ধানের চাষ অন্য কোথাও করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি রয়েছে। তাই মোয়া মানেই জয়নগরের নাম সবার আগে মাথায় আসে।
এখন, প্রশ্ন হচ্ছে বাজারে যে ‘জয়নগরের মোয়া’ লেখা প্যাকেট বিক্রি হয় তার সবই কি আসল?
সে উত্তর দিয়েছেন খোদ মোয়াগ্রামের শিল্পীরাই। ঠিক শুনছেন, এই নামেই পরিচিত জয়নগর থানার অন্তর্গত বহড়ূ গ্রাম। শীতকাল এলেই সেখানকার বাজার অঞ্চলের চেহারা আমূল বদলে যায়।
যেদিকেই তাকানো যায় স্রেফ মোয়ার দোকান। কিছু দোকান স্থায়ী, বেশিরভাগই অস্থায়ী। সব জায়গাতেই বিক্রি হচ্ছে মোয়া। হরেক মাপের, হরেক দামের মোয়া। শুধু বিক্রি হচ্ছে তা নয়, সামনে বসেই মোয়া তৈরি করছেন কারিগররা। কেনার আগে টাটকা মোয়া না খাইয়ে তাঁরা ছাড়বেন না। দোকানে পা রাখলেই নতুন গুড়ের গন্ধে মন জুড়িয়ে যেতে বাধ্য। সেইসঙ্গে ঘি খোয়া ক্ষীর মেশানো অদ্ভুত এক সুবাস। এমনই এক দোকানে ঢুকে দেখা গেল, মালিক খোদ নিজে হাতে মোয়া পাকাচ্ছেন। তাঁর কথায়, নিজে না বানালে মান ধরে রাখা অসম্ভব। তাই দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে দোকানের অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে বসেই মোয়া তৈরি করেন রঞ্জিত কুমার ঘোষ। আসল মোয়া নকল মোয়ার চেনার কী উপায় থাকতে পারে, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন জি-আই ট্যাগের কথা। কয়েক বছর আগে, জয়নগরের মোয়া এই সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে।
তাই মোয়ার প্যাকেটে জি-আই নম্বর দেখে আসল নকলের ফারাক যাচাই করা যেতেই পারে। তবে সেক্ষেত্রে কারচুপি হতে পারে। তাই রঞ্জিতবাবু জোর দিলেন স্বাদের দিকে। আসল কনকচূড় ধানের খই, খাঁটি জিরেনকাঠের নলেনগুড়, বাড়িতে বানানো ক্ষীর আর ঘি মেশানো মোয়া অবশ্যই অন্য রকমের খেতে হবে। তাই একবার আসল বহড়ুর মোয়া না খেলে কোনওভাবেই নকল মোয়া কেন আলাদা, তা বোঝার উপায় নেই। এমনটাই দাবি রঞ্জিতবাবুর। তাহলে সাধারণ মানুষ চিনবেন কীভাবে? খানিক ভেবে সে উত্তরও দিলেন। এক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় মাথায় রাখার পরামর্শ তাঁর। প্রথমেই দামের কথা।
আরও শুনুন: ৫০ টাকায় ১২ টুকরো মাছের আবদার বুড়িমার! সাধারণ মেয়েই যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা
নকল জিনিস অনেক কম দামে পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু আসল মোয়া পেতে গেলে একটু খরচ করতেই হবে। তার মানে অবশ্য এই নয়, যে বেশি দাম হলেই সে মোয়া আসল। সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে মোয়ার রং দেখে। নকল মোয়া-য় ঠিকমতো খেজুর গুড় থাকে না বলেই তাঁর দাবি। তাই এই মোয়া হবে তুলনামূলকভাবে বেশি সাদা। শুধু তাই নয়, প্যাকেট খুললে বেশ ভুরভুরে গন্ধ পাওয়া যেতে পারে। যা কিছুক্ষণ প্যাকেট খোলা রাখলেই উধাও হয়ে যেতে পারে। এছাড়া নকল মোয়ার প্যাকেট হবে বেশ রংচঙে। মানে এককথায় বলতে গেলে, যে জিনিসের মান যত কম, সেই জিনিস বিক্রির ফিকির তত বেশি। কথা বলতে বলতেই মোয়া তৈরি করছিলেন। হাতে ধরিয়ে দিলেন ছোটখাটো ফুটবল সাইজের একটা মোয়া। বললেন, বিয়ে বাড়ির তত্ত্বে এমন মোয়াই দেওয়ার নিয়ম।
এরপর মোয়াগ্রামের হালহকিকত সম্পর্কে বেশ কিছু কথা শোনা গেল রঞ্জিত বাবুর মুখে। বারবার উল্লেখ করলেন ‘শিউলি’-দের কথা। অর্থাৎ এই সময় যারা গাছ থেকে খেজুরের রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করেন তাঁদের কথা। স্থানীয় ভাষায় এঁরাই শিউলি। সূর্য ওঠার আগে গুড় তৈরি শেষ করে ফেলতে হয়। তাই এই কাজ মোটেও সহজ নয়। আর খাঁটি গুড় ছাড়া মোয়া শিল্প বেঁচে থাকাও প্রায় অসম্ভব।
নকল মোয়া চেনার উপায় বাতলে দিলেন আরও এক দোকানি। তিনি অবশ্য মোয়া তৈরির জন্য স্রেফ খই আর গুড়ের মিশ্রণের কথাই বললেন। এর বাইরে আর কিছু ব্যবহার করা একেবারেই মোয়া-সুলভ নয় বলে তাঁর দাবি। আসলে এই মোয়া যখন তৈরি হয়েছিল তখন স্রেফ ওই দুট উপাদানই তাতে ছিল বলে শোনা যায়। সেসময় অবশ্য মোয়াকে মিষ্টি হিসেবেও গুরুত্ব দেওয়া হত না। স্রেফ ওই বিশেষ কনকচূড় ধানের খই আর খাঁটি গুড়। মিশিয়ে নিয়ে মণ্ড তৈরি করলেন কাজ শেষ। তাই বাড়িতেই যে কেউ তৈরি করে ফেলতেন মোয়া। সেইসময় জয়নগরের পূর্ণচন্দ্র ঘোষ এবং নিত্যগোপাল সরকার নামে দুই মিষ্টি ব্যবসায়ী এক নতুন পরিকল্পনা করেন। তাঁরা বুদ্ধি করে মোয়া বানানোর সময় খোয়া ক্ষীর, ঘি, কাজু, কিশমিশের মতো আরও কিছু উপাদান যোগ করে সুদৃশ্য এবং সুস্বাদু একটি মিষ্টি তৈরি করেন। বলা বাহুল্য তাঁদের হাত ধরেই আজকের মোয়া-র জন্ম। তাঁরাই প্রথম বাণিজ্যিক ভাবে মোয়ার উৎপাদন শুরু করেন। সেই রেসিপিই চলে আসছে এখনও। বড় বড় দোকান তো বটেই, ছোটখাটো মোয়ার কারখানাতেও একইভাবে তৈরি হচ্ছে মোয়া। এই কারখানাগুলো অবশ্য মোয়া খুচরো বিক্রির জন্য নয়। এঁরা পাইকারি হিসেবে মোয়া সরবরাহ করেন গোটা দেশে। সামনে থেকে দেখে বোঝা গেল, একই মোয়া বিভিন্ন প্যাকেটে ভরা হচ্ছে। তফাৎ স্রেফ সাজানোয় আর দামে। জানা গেল, এই মোয়ায় গুঁড়ো দুধ কিংবা আরও কিছু জিনিস মেশানো হয়। রঞ্জিতবাবুদের কথা অনুযায়ী এই ধরনের মোয়া-ই নকল মোয়া। তবে সবই তৈরি হচ্ছে জয়নগরের উপকণ্ঠে।
আসল মোয়া সামনে, আর নকল মোয়া খানিক দূরে, গ্রামের ভিতরে। তবে আসল হোক বা নকল, মোয়া তো মোয়া-ই। পিঠেপুলির মতো শীতকালে যেন মোয়া না খেলেই নয়! সবার পক্ষে তো জয়নগর বা বহড়ু গিয়ে মোয়া কেনা সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে যে কোনও দোকান থেকে ‘জয়নগরের মোয়া’ কেনার আগে কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখা যেতেই পারে। বিশেষ করে মোয়া কেনার আগে রং আর গন্ধ যাচাই করে নিতে কিন্তু ভুলবেন না