রাহুল হয়তো স্পষ্ট করে বলে দিতে চান যে, দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই আসলে অধর্ম। গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্মের অর্থ। তা কেবল আচার-অনুষ্ঠান নয়, তা নীতি এবং ন্যায়ও। নীতিহীনতা অধর্ম, অন্যায় অধর্ম। আর তাই ধর্মের তাৎপর্য যদি কারও কারও হাতে গ্লানিপূর্ণ হয় ওঠে, তবে, দেশের মানুষেরই কর্তব্য যে, ধর্মকে পুনরুদ্ধার করা। অবশ্যই তা ন্যায় ও নীতির অর্থে। ন্যায়ের পক্ষে সওয়াল করলেই তা হয়ে উঠবে প্রকৃত ধর্মপালন।
অবশেষে ‘ধর্মযাত্রা’ শুরু করলেন রাহুল গান্ধী। ভারত জোড়ো যাত্রা-র যে নয়া পর্ব, তার পোশাকি নাম ‘ভারত ন্যায় যাত্রা’। উদ্দেশ্য প্রায় একই। তাহলে, যাত্রাপথের এই নাম পরিবর্তন কি নেহাতই পুরনো বোতলে নতুন মদ? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, যাত্রার নামে ‘ন্যায়’ শব্দটি যোগ করে রাহুল তাঁর রাজনীতিকে আরও কেন্দ্রীভূত এবং সংহত করলেন। আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল তাঁর যাত্রার উদ্দেশ্য।
আরও শুনুন: যে শহরে শিশু নেই, সেখানে বড়দিন আসে না
হিন্দিভাষী বলয়ের তিন রাজ্যে ভোটের আগে শুরু করেছিলেন ভারত-জোড়ো-যাত্রা। দেশের রাজনীতিতে তা ছিল অন্যরকম এক স্বপ্নের পদধ্বনি। ভোটবাক্সের রাজনীতি তা প্রভাবিত করতে পারবে কি-না, এ প্রশ্ন অনেকের মনেই ছিল। দেখা গেল, বাস্তবে তা তেমন প্রভাবিত করতেও পারেনি। যথারীতি গেরুয়া শিবির সূক্ষ্ম রাজনীতির অঙ্কে মাত দিয়েছে কংগ্রেসকে। তবে, সেই হার স্বীকার করে নিয়েও রাহুল যা বলেছিলেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরাজয়ের অন্ধকারে দাঁড়িয়েও তিনি স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন যে, সংঘের বিরুদ্ধে তাঁর যে আদর্শগত যুদ্ধ তা থেকে তিনি বিরত হবেন না। অর্থাৎ রাহুল গান্ধীর যুদ্ধটা যে শুধুমাত্রা নির্বাচনের অঙ্কে আটকে নেই, তা বলতে দ্বিধা করেননি তিনি। ভারতীয় রাজনীতি সম্প্রতি যে বিভাজন ও একনায়কতন্ত্রের মুখে পড়েছে বলে বহু মানুষই আক্ষেপ করেন, রাহুল সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা পালটা বয়ান তৈরি করতে চান। তাঁর ভারত জোড়ো যাত্রার এই নতুন পর্বের গুরুত্ব সেখানেই। যদি তিনি তা না করতেন, তাহলে পরিষ্কার হয়ে যেত যে ভোটে জেতাই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু তিনি তো বারবার বলেছিলেন যে, বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে ভালোবাসার কথা বলতেই তিনি পথ হাঁটছেন। প্রায় হাজার চারেক কিলোমিটার পথ হেঁটে এই একটা বার্তাই তিনি দিতে চেয়েছিলেন, যা কেবল ভোটের ফলাফলে আটকে থাকতে পারে না। নতুন যাত্রার ঘোষণা করে রাহুল বুঝিয়ে দিলেন যে, সত্যিই তা ভোটের দেনাপাওনায় সীমাবদ্ধ নয়। নতুন যাত্রার প্রথম গুরুত্ব এখানেই।
আরও শুনুন: বাবা সোমনাথ মন্দিরের রূপকার, ছেলের নকশায় তৈরি হচ্ছে অযোধ্যার রাম মন্দির
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, এবারে যাত্রার সঙ্গে তিনি ‘ন্যায়’ শব্দটি যোগ করেছেন। বলছেন, এবার তিনি পথ হাঁটবেন সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়ের লক্ষে। বিশেষজ্ঞদের নজর এড়ায়নি, যে এই ‘ন্যায়’ শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে ‘ধর্ম’ শব্দটিও। ভারতীয় দর্শনে ধর্মের যা অর্থ এবং ব্যাপ্তি, তা ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন’ শব্দের মধ্যে আঁটে না। ভারতীয় ধর্ম যেমন নীতির প্রতি নির্দেশ করে, তেমনই ন্যায়ের পক্ষেও। যে অর্থে গোটা মহাভারত হয়ে ওঠে ধর্মযুদ্ধ। অর্থাৎ আখেরে ন্যায়ের পক্ষে, ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষে যুদ্ধ। রাহুল খুব কৌশলে সেই ন্যায়ের যুদ্ধই শুরু করে দিলেন। সন্দেহ নেই যে, এই মুহূর্তে ভারতবর্ষের রাজনীতি যে নানা ভাবে বিভাজিত, তা মূলত ধর্মকে কেন্দ্র করে বলেই মনে করা হয়। তবে স্পষ্ট করে বলতে গেলে, তা আসলে সম্প্রদায়গত বিভাজন। নতুন যাত্রাপথে যে মণিপুরে যাবেন রাহুল, সেখানে এই সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর বিভাজনই আগুন জ্বালিয়েছে। রাজনীতির চর্চাকারীদের অনেকেরই আক্ষেপ, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিভাজনের বীজ যা ছিল দেশের সর্বত্র, তা জল-হাওয়া পেয়ে এতদিনে প্রায় মহীরূহে পরিণত হয়েছে। অন্যায় হচ্ছে নানা ক্ষেত্রেই, এবং নানা ভাবে। নতুন যাত্রাপথে সেই সব চলতে থাকা অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের বার্তা দেবেন রাহুল। মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অসম, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা হয়ে ক্রমশ উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাবেন রাহুল। এই পর্বে অতিক্রম করবেন প্রায় হাজার ছয়েক কিলোমিটার রাস্তা। অর্থাৎ ভারত জোড়ার যে বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল রাহুলের, তাই-ই পূরণ করছেন তিনি। তবে, বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ভালোবসা- এই বার্তার মধ্যে যেন অনেকখানি নরম সুরে আবেদন ছিল। অনেকাংশে তাকে কাব্যিকও বলা যায়। যে মানবতা ও ভালোবাসার কথা বলেন হিউম্যানিস্টরা, কার্যত রাজনৈতিক যাত্রায় সে কথাই বলেছিলেন রাহুল। এবার ন্যায়যাত্রায় পৌঁছে, তাঁর সেই লক্ষ্য অনেক সংহত হল। রাহুল স্পষ্ট করেই বলে দিলেন, দেশে যে অন্যায় হচ্ছে, তার বিরুদ্ধেই তাঁর যাত্রা। আরও স্পষ্ট করে বলে দিলেন হয়তো যে, দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই আসলে অধর্ম। গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতিতে ধর্মের অর্থ। তা কেবল আচার-অনুষ্ঠান নয়, তা নীতি এবং ন্যায়ও। নীতিহীনতা অধর্ম, অন্যায় অধর্ম। আর তাই ধর্মের তাৎপর্য যদি কারও কারও হাতে গ্লানিপূর্ণ হয় ওঠে, তবে, দেশের মানুষেরই কর্তব্য যে, ধর্মকে পুনরুদ্ধার করা। অবশ্যই তা ন্যায় ও নীতির অর্থে। ন্যায়ের পক্ষে সওয়াল করলেই তা হয়ে উঠবে প্রকৃত ধর্মপালন।
অর্থাৎ, রাহুলের এই নয়া যাত্রা আসলে অধর্মের বিরুদ্ধে ধর্মযাত্রা-ই। প্রশ্ন শুধু একটাই, দেশের মানুষকে রাহুল সে কথা আদৌ বুঝিয়ে উঠতে পারবেন তো? নেহাত হাঁটার খাতিরে হাঁটা হয়েই তা থেকে যাবে না তো!