শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। জন্মদিন ছাড়াও যে বাড়িতে কেক আনা যায়, বাঙালিকে সে কথা শিখিয়েছে শীতকালই। সান্তাক্লজের ঝোলা হাতড়ে সেই কেকের পসরা তুলে আনলেন শৌভিক মুখোপাধ্যায়।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
নদীর পাড়ে উদাস হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দাদা। সামনে গিয়েই চমকে গেছি। একটু আগেই ব্যাডমিন্টন ম্যাচে প্রকাশদাকে মাটি ধরিয়ে দেওয়া সুদীপ মুখুজ্জে, পিকনিকের শুরু থেকে সবাইকে মাতিয়ে রাখা চিকু এক নিমেষে শান্ত। বিষয়টার মীমাংসা হওয়া দরকার। লাঞ্চের মেনু থেকে সরিয়ে রাখা কয়েক কেজি চিকেন, ধোঁয়া ওঠা পকোড়া হয়ে ঘুরছে সবার প্লেটে। যথেচ্ছ সাবাড়ের আশঙ্কা মাথায় নিয়েও সেইজন্য ডাকতে আসা। যদিও ওর হাবভাব দেখে মরজগতের প্রতি কোনও আকর্ষণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ‘সবাই খেতে ডাকছে, চল’ শুনে এমন এক দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল, দু-পা পিছিয়ে এলাম। “যারা ভালোবাসেনি তারা কীভাবে বুঝবে ভিড়ের মধ্যেও একা থাকার মানে! চারদিকে এত বাধা, এত সংগ্রাম…” কথা ফুরোবার জন্য আর দেরি করিনি। একলা চলো-র থেকে চিকেন পকোড়াই বেশি সংগত বুঝে টিকিয়া উড়ানে ফিরে গেছি জটলায়। এ কারণেই বোধহয় আজও আমার ভালোবাসা হয়ে উঠল না।
প্রায় সংবচ্ছর জ্যামে আর ঘামে নাস্তানাবুদ হয়ে শীতে বাড়তি এনার্জিটুকু পেয়ে সবাই আতান্তরে পড়ে যায়। কী করবে ভেবে উঠতে পারে না। একদল যায় পিকনিকে আর অন্য দলে জয়নগর। এর বাইরে আরেক দল আগামী তিনমাসে কদিন কতটুকু স্নান করবে তার ব্লুপ্রিন্ট ছকে নেয়। দুপুররাতে গা শিরশিরিয়ে উঠলেই ট্রাঙ্কবন্দি শাল, সোয়েটার নরম রোদে বেরোবে। পুরনো মাঙ্কিক্যাপ উসকে দেবে নস্ট্যালজিয়া। বাবার সোয়েটার অথবা মায়ের কার্ডিগানে আনমনা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, নতুন বইয়ের গন্ধের মতো তোলা জামার ন্যাপথালিনের গন্ধ আরেকটু বেশি সময় বুকে ভরে নিতে ইচ্ছে করবে। শীত আসলে স্মৃতির ঋতু। উলের পোশাকে, লেপের ওমে যে স্মৃতি জমা থাকে। জমা থাকে হঠাৎ পিকনিকের হুল্লোড়, চিড়িয়াখানার ভিড়ে, বড়দিনের প্লাম কেক, বইমেলার ধুলোয় আর সরস্বতী পুজোর অঞ্জলিতে। কৈশোরের দুর্গাষ্টমীকে অল্প ব্যবধানে পিছু ফেলে বসন্ত পঞ্চমী। অবশ্য উঠল বাই তো উইকেন্ড ট্রিপে গিয়ে পিকনিকের মজা এখন আর আলাদাভাবে মালুম হয় না। যেমন শীতের টেস্ট ম্যাচের চেয়ে ভরা গ্রীষ্মের ক্রিকেট লিগ ক্রমে মন মজিয়েছে। তবু ‘বনভোজনের ব্যাপার’ বড়ই উপাদেয়। রাশভারী বড় পিসেও এদিন ফাজিল দি গ্রেট। রান্নায় নুন কম হলেও বকুনি মাফ। চরম দৌরাত্ম্যিতে প্রশ্রয়ের অভয়। আড্ডা, অন্ত্যাক্ষরী, মিউজিক্যাল চেয়ার। দৌড়তে গিয়ে ছোটমাসি পা মচকে ফেললে খেলা বন্ধ। লাঞ্চ ব্রেক। একটু জিরিয়ে ক্রিকেট ব্যাট হাতে নেমে পড়া। লুজ বলে আউট হওয়ার পর ভাইয়ের ফুর্তি দেখে দাদার লাখ টাকার হাসি। সবসময় যে জিততে নেই তা তো শারুক্ষানের আগে এখান থেকেই শেখা। ফেরার পথে মনখারাপ। যার যার বাড়িতে থেমে তাদের নামাতে নামাতে আসছে গাড়ি। ছোটরা তখনও বকছে অবিরাম। বড়রা চুপ। হয়তো দেখা হবে দিনকয়েকের মধ্যেই, কিন্তু সবাই মিলে দেখা হতে আবার এক শীতের অপেক্ষা। ততদিন স্মৃতির গোড়ায় জল ঝিরিয়ে যাওয়া। পরের পিকনিক শুরু হবে এই পিকনিকের গল্প থেকেই।
-: শুনুন শীতকাতুরে অন্যান্য গল্প :-
সোয়েটারের ভাঁজে ন্যাপথালিনের বসতি
শীত শীত স্নানঘর, গ্লিসারিনের খুশবু
পাশাপাশি মোয়ার মানচিত্রে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে ওঠে। জয়নগর না বহড়ু কোথাকার মোয়া সবচেয়ে ভালো, এ তর্কের মীমাংসা না হলেও অঘ্রান শেষের লক্ষ্মীকান্তপুর বা নামখানা লোকালের বেশিরভাগ ফ্লাইং প্যাসেঞ্জারের গন্তব্য যে শুধু বকখালি বা মৌসুনী আইল্যান্ড নয়, তা এই দুই অঞ্চলের মিষ্টির দোকানে খদ্দেরদের লাইন দেখলেই বোঝা যায়। গঙ্গাসাগর মেলার পুণ্যার্থীদের ভিড়েও এই জমায়েতে ভাটা পড়ে না। ট্রেনে না হলে সড়কপথই সই। দুবেলা কষে গুড়-মোয়া খাবই। খাদ্যরসিক বাঙালির মোক্ষম ট্যাগলাইন। মোয়া, গুড়ের সঙ্গে সমান সমান পাল্লা দেয় কেকের পসরা। বাঙালি জানে বাপুজি তার নেসেসিটি। সঙ্গে এই তিনমাসে রিচ ফ্রুট কেক, প্লাম কেকের লাক্সারিটুকুও সে চেটেপুটে নিতে ছাড়ে না। জন্মদিন ছাড়াও যে বাড়িতে কেক আনা যায়, সে কথা নিজের পাশাপাশি মানিব্যাগকেও কনভিন্স করিয়ে ফেলে। খবর কাগজ মোড়া চায়ের দোকানের কাটা কেক নয়, আস্ত কেক বাজারের ব্যাগে ভরে বাড়িমুখো হয়। নাহুমস, সালদানহার পাশাপাশি ছোট ছোট বেকারিগুলোও ব্রেকফাস্ট টিফিনে অন্যরকম স্বাদের জোগান দিতে তৈরি থাকে। পিঠে-পার্বণের ভাটায় কেকের গ্রাফ আরও উঠছে। পাটিসাপটা, সরুচাকলি, মুগতক্তি, রাঙা আলুর পিঠে, রসবড়া, মালপোয়ার জনপ্রিয়তা রক্তে চিনির মাত্রার ব্যস্তানুপাতিক। সময় সাপেক্ষেও। যৌথ পরিবারের দশে মিলি পৌষপার্বণ নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে মিষ্টির দোকানের ময়রার হাতে এসে ঠেকেছে। তার চেয়ে কেক ভালো। মাপমতো সব মিশিয়ে বেক করতে বসিয়ে টাইমার সেট করে দিলেই কেল্লাফতে। আগুনতাতে অত খাটুনির সময় কোথায়! যেখানে সামান্য আঁচের হেরফেরেই পিঠের স্বাদ বদলে যাওয়ার ভয় থাকে! ফের নতুন করে সব শুরু করতে হয়। তার চেয়ে সময় বাঁচিয়ে পার্ক স্ট্রিট ভ্লগ হোক। তেরো পার্বণের অ্যাডিশন্যাল পার্বণ সেলিব্রশন করার সময় এসেছে। সান্তাক্লজের ঝোলায় থেকে বেরিয়েছে ক্রিসমাস।
ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে সেকালে কলকাতায় বড়দিনে জাঁকজমক হত বটে। বিশেষ করে নভেম্বর ডিসেম্বরেই গণনা করে দেখা হত ভাগ্যান্বেষণে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে পৌঁছনো গোরারা রোগবালাই সামলে কজন শেষ পর্যন্ত ফৌত হল আর কজনই বা নতুন বছর দেখার জন্য বেঁচে রইল। বড়দিনের রোশনাইও তাই ছিল বেশি। বাঙালি বেনিয়ারা সাহেবদের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে উপহারের পিছনে জলের মতো পয়সা খরচ করতেন। হঠাৎ বাবুরাও পিছিয়ে ছিলেন না। পরে কোম্পানির উপরমহল থেকেই ফুর্তিতে রাশ টানা হয়। সেই মাতামাতিই যেন আবার এসেছে ফিরিয়া। উৎসববঙ্গে যেকোনো উপলক্ষ্যই এখন একদিনে ফুরোবার নয়। খ্রিস্টোৎসবও তাই উদযাপনের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছে নিউ ইয়ার অবধি। তবে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে মোমবাতির জ্বালিয়ে স্ট্যাটাস আপডেটের বাইরেও এক বড়দিন আছে। বো ব্যারাকসের গলিঘুঁজিতে যার খোঁজ মেলে। অথবা গ্রাম মফস্সলের গির্জায়। যেখানে সন্ধে থেকে জড়ো হয়েছে ধর্মান্তরিত বাঙালি খ্রিস্টানরা। দূরের গির্জায় পবন পল, অমল গোমস, এলিজাবেথ বর-রা সমবেত ভজনায় ছন্দে বেঁধেছে উপাস্যের উপদেশ। বড়দিন উপলক্ষে গাওয়া হচ্ছে সেই গান। যিশুর গান। এমন উদযাপনও ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। শীতকাল কুয়াশার আড়ালে লুকিয়ে আছে রুটম্যাপ। খুঁজে দেখার অপেক্ষা।
শীতকাল তো কেবল ঋতু নয়। অনুভূতির সমার্থক। পারদের বাড়া কমায় তার আসা যাওয়া। প্রবল জ্বরে বুঝতে পারি শীত করছে। বিনা ছাতায় উপুড়ঝুপুড় বৃষ্টি ভিজে বাড়ি ফেরার সময় শীত করে। প্রবল ভয়ের মুখোমুখি হয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে যে স্রোত, স্বভাবধর্মে সেও তো শীতের কাছাকাছি। উষ্ণতার বিপরীতে বসে থাকে শীত। রিক্ততা নিয়ে। নীরবতা নিয়ে। ফিরতি ওমের প্রত্যাশা নিয়ে। কেউ আমাদের তা জুগিয়ে দেয়। নয়তো আমরা নিজেই তার ব্যবস্থা করে ফেলি। শীতকে আমরা বেশি সময় চোখের আড়াল রাখতে পারি না। বরাদ্দে কম পড়লে পাহাড়ে শীতের দখল নিতে যাই। শীতকাতুরে বাঙালি আর শীত ফুরোতে চায় না।