শীতের চাদরে স্মৃতির ওম। কথায় কথায় দশকাহন, বাঙালির নির্ভেজাল শীতযাপন সংবাদ প্রতিদিন শোনো-য়। ‘শীতকাতুরে’ বাঙালির ড্রিম-ক্রিম বোরোলীন গায়ে মাখার গল্প শোনালেন সুতীর্থ দাশ।
অলংকরণ: অর্ঘ্য চৌধুরী
বাঙালি এখন নাকি কোনও কিছুই গায়ে মাখে না। সরকারে কে আছে আর দরকারে কে নেই, তাতে তার আজ আর নাকি কিছু যায় আসে না। দস্যি-দামালদের ছোট ঘটনা হোক বা বিরাটের সেঞ্চুরি– সেখানেও কোনও উত্তেজনার রসদ খুঁজে পায় না সে। প্রোমোশন নিয়েও তার কোনও ইমোশন কাজ করে না।
বাসে, ট্রামে কিংবা মেট্রোতে প্রায়ই দেখা যায়– হঠাৎ দুজন লোক যখন কনুইয়ের গুঁতো কিংবা জুতো দিয়ে পা মাড়িয়ে দেওয়া নিয়ে তুলকালাম জুড়ে দেয়, তখন আশেপাশের সকলে কী সুন্দর চোখ ঢুলুঢুলু চোখে নির্বিকার ভাবে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে থাকে। কী অসম্ভব সহিষ্ণুতা- নির্বাণের একেবারে চরম স্তরে বোধহয় এমনটাই হয়। ‘বলো আর কও, কানে দিয়েছি তুলো, মারো আর ধরো, পিঠে বেঁধেছি কুলো’। বাঙালির এই সর্বংসহা মনোভাবই বোধহয় একসময় তাকে বিপ্লবী করে তুলেছিল। সেই বিপ্লবী বাঙালি এখন তার চতুর্দিকে শুধুই “লবি” দেখে। বাকি সমস্তটাই তার জীবনে ‘বিপ’ শব্দে চাপা পড়ে গেছে।
তবে অনেক কিছুতেই সে স্তব্ধ থাকলেও, একটা বিষয়ে প্রবলরূপে জব্দ। হেমন্তের শেষে, হালকা হিমেল হাওয়ার পরশে সে বড্ড কাতর হয়ে পড়ে। অন্তরাত্মা তখন, ইংরেজিতে নয়- বাংলায় ‘ওহ শীত, ওহ শীত’ বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে। বোঝা যায় বাঙালি বাবু একেবারে কাবু হয়েছেন।
বসন্তে বাঙালির প্রাণে যতই দখিনা বাতাস বয়ে যাক আর কৃষ্ণচূড়া সেই প্রাণে যতই আগুন জ্বালাক, শীতের উত্তুরে হাওয়ায় তার প্রাণ কেঁপে ওঠে। আর, একবার যদি পৌষ-মাঘের পালায় আর আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের সৌজন্যে দু-এক পশলা বারিধারা তার উঠান ভিজিয়ে যায়, তাহলে তো কথাই নেই- মাঙ্কি-ক্যাপ আর ফুল-হাতা সোয়েটার মণ্ডিত বাঙালিকে আর দেখতে হচ্ছে না। যে বাঙালি তেলে-জলে মানুষ, তাকে শুধু একবারটি কোনও পুকুরের ধারে নিয়ে গিয়ে বলুন, ‘নাইবি? চ!’, দেখবেন সে ‘নৈব নৈব চ’ বলে চিৎকার করে উঠবে। শীতকালে জলাতঙ্কে ভোগা বাঙালি জল গায়ে দেবে? কভি নেহি!
তবে হ্যাঁ, বাঙালি অনেক কিছুই গায়ে মাখে না ঠিকই, কিন্তু এই ধরাধামে একটি বস্তু অবশ্যই আছে যেটিকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে। যার স্পর্শে অঙ্গে অঙ্গে কে যেন বাঁশি বাজায় যার ফলে তার মন প্রাণ দুলে ওঠে। সে আজকের কথা তো নয়– দীর্ঘকাল ধরেই সে বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে বিরাজ করছে। বাড়ির সে এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। পরিবারের সকলের স্নেহের পাত্র। সারাবছরই তার কাজ থাকলেও শীতকালে সে প্রায় গৃহকর্তার সমতুল্য। ঠোঁট থেকে পায়ের গোড়ালি তার পরশের মুগ্ধতায় বিলীন। বাঙালির সেই শৈতবান্ধবের নাম বোরোলীন। তাকে ছাড়া শীতকালে বাঙালির মুভমেন্ট রেস্ট্রিক্টেড হয়ে পড়ে– তাকে ছাড়া তো কিছুতেই চলবে না। ওই একটি বস্তু বাঙালি গায়ে মাখতে কার্পণ্য করে না। সে জানে – ওই একটু বস্তু গায়ে মাখলে যে জীবনের কোনও ওঠাপড়া গায়ে লাগে না।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাবলুর ছোটজেঠুর ঠোঁটে চায়ের কাপের আগে স্পর্শ পায় বোরোলীন। একগাদা ক্রিম আঙুলে নিয়ে দাঁত মাজার মতন করে দাদু ঠোঁট মেজে পুরো অঞ্চলে সাদা ক্রিমের প্রলেপ দেন। তারপর ফুলহাতা সোয়েটার গায়ে চাপিয়ে, মাঙ্কি ক্যাপ মাথায় দিয়ে মশারির বাইরে বেরিয়ে হাঁক পাড়েন, ‘শুনছ! আমার মোজা আর শাল কই? দেখতে পাচ্ছি না যে।’
সেই হাঁক শুনে ছোটজেঠি দোতলা থেকে দুদ্দাড়িয়ে নেমে আসেন। পাঁচ মিনিট দেরি হলে কত্তা বাড়ি মাথায় তুলবেন। বাবলুর ছোটজেঠু রগচটা আর বদমেজাজি হলেও তিনি কিন্তু শীতে এক্কেবারে জব্দ। কালীপুজোর পর থেকেই স্ত্রীকে তাগাদা দিতে শুরু করেন, ‘গরম কাপড় সব এবার বার করো, রোদে দাও। শীত তো পড়ে গেল, আর কবে দেবে? পয়লা বৈশাখে?’
ছোটজেঠুর বৈশিষ্ট হল তিনি হেমন্তের শেষে যে গরম জামা গায়ে তোলেন, সে জামা গা থেকে নামান একেবারে বসন্তের মুখে। এই হেমন্ত আর বসন্তের মাঝের যে হিমসেতু– সেটা পার করা যে কত কষ্টের, সেটা শুধুমাত্র জানেন বাবলুর ছোটজেঠু। আর জানে ছোটজেঠুর বোরোলীন।
শুধু ছোটজেঠু কেন? বাবলুর ছোড়দি রিয়াও কি কম যায়? দাদুর যেমন এক ক্রিমে শীত কাবার, ছোড়দির কিন্তু ড্রেসিংটেবিলে নানান ক্রিমের সম্ভার। শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য গড়ে একটা করে ক্রিম বরাদ্দ– কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুটো করেও আছে। মুখের জন্য ফেস-ক্রিম আর শরীরের অন্যান্য স্থানের জন্য আছে বডি-লোশন। তবে এই দলে পায়ের পাতা পড়ে না। পায়ের পাতা– বিশেষ করে গোড়ালির জন্য আলাদা ‘ফুট-ক্রিম’। এরকম আরও কত কিছুই না আছে।
ছোড়দি সম্ভবত বাঙালি না– এটা বাবলুর সবসময় মনে হয়। ছোড়দির শীত কম লাগে কী করে? ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে বলে সবসময় ফটর ফটর করে ইংরেজিতে কথা বলে। ফোনে অফিসের বন্ধুদের সাথে হিন্দিতেও কথা বলে। মাঝে মাঝে ছোটজেঠুর মতন “ওহ শীত ওহ শীত” করে ফোনে ছোড়দিকে চিৎকার করতে শুনেছে বাবলু। অবশ্য সেটা সারাবছরই করে ছোড়দি। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, কী বর্ষা – সব সময়েই বাবলু তার ছোড়দিকে ওটা বলতে শুনেছে। তাই বলে এটা ভাবলে চলবে না যে ছোড়দি শীতকাতুরে। তার অফিসের ড্রেস দেখে বাড়ির সকলের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়। জিন্সের ওপর একটা গোল গলার টি-শার্ট আর তার ওপর একটা ফিনফিনে বুকখোলা কার্ডিগান– সামনের সব কটা বোতাম খোলা।
‘মামণি এটা কী হচ্ছে? ঠান্ডা লেগে যাবে তো! খবরে বলল রামপুরহাটে বৃষ্টি হচ্ছে। এই অসময় বৃষ্টির মানে বোঝো?’ রিয়ার মা মেয়েকে ওই মলিন বেশভূষায় দেখে চিৎকার করে উঠলেন।
‘রিল্যাক্স মম, রামপুরহাট গড়িয়াহাটের পরের স্টপ নয়। ট্রেনে ওভারনাইট জার্নি’, রিয়া উত্তর দিল।
‘তাতে কী হয়েছে। তার একটা এফেক্ট আছে তো।‘ মা পালটা উত্তর দিল মেয়েকে।
‘ইউ মিন বাটারফ্লাই এফেক্ট?’
রিয়ার কথাটা শুনে মা আর কিছু বুঝলেন না। চুপ করে গেলেন, তারপর গজগজ করতে শুরু করলেন, ‘যা খুশি হয় করো। বড় হয়েছ, নিজের ভালমন্দ নিজেই বোঝো। আমরা আর কদিন। ঠান্ডা লাগলে তখন এসে বেড়ালের মতন কুঁই কুঁই করলে দেখে নেব।‘
এ গল্প বাঙালির “ঘর ঘর কি কাহানি”– এ গল্প চিরন্তন। এ গল্প শীতকাতুরে বাঙালির মাস দু-একের জন্য অশীতিপর হয়ে ওঠার গল্প। সব ফেলে বাঙালির ড্রিম-ক্রিম বোরোলীন গায়ে মাখার গল্প। বাঙালি জানে সব কিছু কিন্তু গায়ে মাখলে চলে না। তাই বলে কি শীতে বাঙালি দোরে খিল এঁটে বসে থাকে? মোটেই না। খেলা-মেলা সবেতেই আছে বাঙালি। কী অদ্ভুত না – শীত মানেই কলকাতায় খেলা আর মেলা… আর পিকনিক। কী চাই? বাঙালি বেছে নিক। গ্লোবাল ওয়ার্মিং মানুষকে ভাবাচ্ছে ঠিকই। যতদিন শীত আছে, বাঙালির এই নিজের সাথে শৈত্যযুদ্ধ হয়তো থাকবে ।
তবে একটা কথা কিছুতেই মাথায় ঢোকে না– এত শীতকাতুরে বাঙালি দার্জিলিং-নৈনিতাল কী করে ঘুরতে যায়?