মুসলিম মেয়েরা হিজাব পরবেন নাকি পরবেন না, তা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে বারে বারেই বিতর্ক উসকে উঠেছে দেশে। আর সেই হিজাব বিতর্কের ভারতবর্ষেই বোধহয় এই মুহূর্তে আরও জরুরি হয়ে উঠেছেন বেগম রোকেয়া। নারীর এই পর্দা টানার বিধানকে যিনি বারবার খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন, প্রশ্ন করতে চেয়েছেন। ‘অবরোধবাসিনী’-দের নিয়ে রোকেয়ার ভাবনা ফিরে দেখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
ঠিকমতো হিজাব পরা নেই, এই অভিযোগে ইরান পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মাহসা আমিনি। তারপর যে কীভাবে তাঁর মৃত্যু হল, সে কথা নাকি কারোরই জানা নেই। এরও বেশ কয়েক বছর আগে, স্কুলে যেতে চেয়েছিলেন বলেই তালিবানের গুলি খেতে হয়েছিল পাকিস্তানি কিশোরী মালালাকে। নানা দেশে নারীর পর্দাপ্রথা নিয়ে কড়াকড়ির এমন একাধিক ঘটনা বারে বারেই আমাদের সামনে এসেছে। আচ্ছা, তার প্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থানটি ঠিক কেমন? সেদিকে নজর ফেরালে দেখা যাচ্ছে, বিশ শতকের শুরুতে মুসলিম মেয়েদের জন্য স্কুল খুলে একইভাবে হুমকির মুখে পড়ছেন এ দেশের এক মুসলিম নারী। স্কুলের গাড়ির জানলা দিয়ে বোরখা-পরা ছাত্রীদের হাত দেখা যাচ্ছে, এই অভিযোগে রক্ষণশীল মুসলিমদের থেকে হুঁশিয়ারি পেয়েছিলেন তিনি। তবুও, পর্দার আড়ালে নিজের মুখ কিংবা মত, কোনোটিকেই ঢাকতে চাননি সেই নারী। সেই না-মানার পথে তিনি একা হাঁটতে চাননি, বরং তাঁর মতো আরও অনেক মুসলিম মেয়ে যাতে সেই আলোয় জারিত হয়ে ওঠে, তার জন্যই আজীবন কথা বলে গিয়েছেন তিনি। তিনি আর কেউ নন, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন।
আরও শুনুন: নারীর স্বাধীনতার জন্য লড়াই, মেহবুবা-মহম্মদির নোবেল স্বীকৃতিই যেন সত্যিকার দেবীপক্ষ
কঠোর অবরোধ মেনে বড় হয়ে ওঠা রোকেয়া দেখেছিলেন, তাঁকে বাংলা, ইংরেজি পড়ানোতেও বাড়ির আপত্তি। যেখানে নারীশিক্ষা বিষয়টিই এমন অন্ধকারে, সেখানে নারীর স্বনির্ভরতা, স্বাধীনতার পথ আর কতটুকু? তাই সমাজ যে দরজা মেয়েদের জন্য বন্ধ রেখেছিল, মেয়েদের জন্য সেই দরজাই খুলে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তার সঙ্গে রোকেয়া এ কথাও বুঝেছিলেন যে, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে মেয়েদের সচেতন করে তোলাও সমান জরুরি। কারণ যুগের পর যুগ যারা অধিকার না পাওয়াকেই নিয়ম বলে জেনে এসেছে, তারা হাতের নাগালে অধিকার এলেও তা সবসময় দখল করতে পারে না। ‘অবরোধবাসিনী’ বইয়ে তাই রোকেয়া দেখান, পর্দা ও বোরখার সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে কেউ চোরের হাতে পর্দার আড়াল থেকে নীরবে সব গয়না দিয়েছে, কারও রেল লাইনে প্রাণ গেছে, কেউ বা বাড়িতে আগুন লাগলেও পুরুষের সামনে বেরোনো যাবে না বলে আগুনেই পুড়ে মরেছে। অবরোধে আটকে পড়া এই নারীদের পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেরিয়ে আসার বার্তা দিতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই একদিকে রোকেয়া বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, গড়ে তোলেন মুসলিম মহিলা সমিতি, অন্যদিকে একের পর এক লেখায় লিখে চলেন মুসলিম মেয়েদের অবস্থা আর তা থেকে উত্তরণের কথা। ‘সুলতানার স্বপ্ন’-এ লেখেন শিক্ষিতা অবরোধহীন স্বাধীন নারীর কথা। ‘অবরোধবাসিনী’-র সত্যি ঘটনায় তিনি সেই নীরব মেয়েটির কথা লেখেন, আকস্মিক বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় যাকে এক লম্পট মাতালের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল আর মেয়েটিকে চিমটি কেটে তার আর্তনাদটিকেই বিয়ের সম্মতি বলে গণ্য করা হয়েছিল। সেই মেয়েদের দেখেছিলেন বলেই ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে তিনি নির্যাতিত নারীদের নতুন ঠিকানা গড়ে দেন। অপমানিত দাম্পত্যে মাটি কামড়ে পড়ে না থেকে মেয়েরা আশ্রয় পায় তারিণী-ভবনে, কাজ শিখে নিজের জোরে বাঁচার স্বপ্ন দেখে।
আরও শুনুন: আর এক মালালা! তালিবান হানায় ভাঙা দেওয়ালে ছবি আঁকেন কাবুলের অ্যাসিড আক্রান্ত তরুণী
রোকেয়ার সময় থেকে অনেকদিন এগিয়ে এসেছি আমরা। তবু এই ভারতেও হিজাব নিয়ে বিতর্ক হয়। একদিকে জোর করে হিজাব চাপাতে চায় কেউ, অন্যদিকে কেউ নিজস্ব প্রোপাগান্ডাতেই সে হিজাব খুলতে চায়, আর এ দুয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে মুসলিম মেয়েরা অনেকেই নিজেদের চাওয়া-পাওয়া নিয়েই দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার বিরুদ্ধে জারি করা নির্দেশিকা নিয়ে সাম্প্রতিক কালেই উত্তাল হয়েছে দেশ। সেখানে দেখা গিয়েছে, মুসলিম মেয়েদের একটা বড় অংশই পর্দার পক্ষে কথা বলছেন। শিক্ষিত, স্বনির্ভর অনেক মেয়েও রয়েছেন সে দলে। ফলে এই নির্বাচন কতখানি মেয়েদের নিজস্ব, আর কতখানি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি সূত্রে প্রাপ্ত, সে নিয়ে দ্বন্দ্ব এতদিন পরেও মিটছে না। উপরন্তু হিন্দু মৌলবাদ যেখানে প্রবল হয়ে উঠছে, সেখানে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়েই যে অনেকে মুসলিম পিতৃতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করছেন, সে কথাও এড়িয়ে যাওয়া চলে না। আর তখনই বোঝা যায়, একশো বছর পেরিয়ে এসেও ফুরিয়ে যাননি রোকেয়া। বরং হিজাব বিতর্কের এই ভারতবর্ষে তাঁকে মনে রাখা, মেয়েদের নিজেদের জন্যই বড় জরুরি।