আমাদের যা কিছু ভুলে যাওয়া, তা নেহাত আকস্মিক নয়। বরং বৃহত্তর ভুলিয়ে দেওয়ারই ষড়যন্ত্র। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-কাঠামোয় যে যেখানে দাঁড়িয়ে, তার উপর ভিত্তি করেই চলে এই ভুলিয়ে দেওয়ার খেলা। সেই সম্মিলিত বিস্মৃতির প্রতিনিধি হয়ে, স্মৃতি ও সংগ্রাম জাগিয়ে তোলার কথাই কি মনে করাল ‘কড়ক সিং’? অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর নতুন ছবির প্রেক্ষিতে ভেবে দেখলেন সরোজ দরবার।
বিস্মৃতির বিপ্রতীপে স্মৃতির যে সংগ্রাম, তাই-ই প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম। আকস্মিক আমাদের যা কিছু ভুলে যাওয়া, তা নেহাত আপতিক নয়। বরং বৃহত্তর ভুলিয়ে দেওয়ারই ষড়যন্ত্র। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-কাঠামোয় যে যেখানে দাঁড়িয়ে, তার উপর ভিত্তি করেই চলে এই ভুলিয়ে দেওয়ার খেলা। যেভাবে অদৃষ্টবাদ এসে ভুলিয়ে দিয়ে যায় কার্য-কারণ সম্পর্ককে, মানুষে শ্রেণিচেতনাকে। সুতরাং এই বিস্মৃতির বিরুদ্ধে অবিরত স্মৃতি উদ্ধারের প্রক্রিয়াই আখেরে ক্ষমতার বিরুদ্ধে সাধারণের অনিবারণীয় সংগ্রামের মুখবন্ধ রচনা করে দেয়। ইতিহাসের গড় প্রবাহ সে-লড়াইকে তেমন স্বীকৃতি দিক বা না দিক, তা ঐতিহাসিক। কেননা তা সমাজের মুখকে শুধু নয়, মনকেও চেনায়। মিলান কুন্দেরার এই দর্শন তাই প্রতিদিন, প্রতি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তাঁর চলে যাওয়ার মাস কয়েক পরে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘কড়ক সিং’ দেখতে বসে মনে হল, কী অনিবার্য এবং অমোঘ মূর্তায়ণ কুন্দেরার সেই অক্ষরমালার।
কড়ক সিং-কে আমরা চিনি। খুব একটা অচেনা তিনি নন। আমাদের আশেপাশে মাথা উঁচু করে যে সব মানুষেরা এখনও ঘুরে বেড়ান, তাঁদের সকলকেই কড়ক সিং বলা যায়। শুধু কড়ক সিং যখন বিস্মৃতির কবলে পড়েন, এবং সংগ্রাম করেন, তখন তিনি আমাদের কাছে অনেকটাই অচেনা হয়ে যান। কেন-না আমরা কড়ক সিং-দের বাইরে থেকে দেখি, মনে মনে তারিফও করি, দরকারে মালা-উত্তরীয় দিয়ে সংবর্ধনাও দিই। তবে তাঁর যন্ত্রণা আর দুর্ভোগের ভিতর ঢুকতে ভয় পাই। পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী তাই একখানা খেলা শুরু করেন। হাতে আছে তুরুপের তাস পঙ্কজ ত্রিপাঠী। অতএব খানিকটা মজা, রসিকতা, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল দিয়ে তিনি গল্পটি এমনভাবে বলতে শুরু করেন, যেন, গল্পটি এইমাত্র নির্মিত হচ্ছে। এবং দর্শক নিজেও যেন সেই নির্মাণপ্রক্রিয়ার অংশ। পঙ্কজ, এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন অভিনেতা। ফলত এই খেলায় দর্শককে টেনে নিতে তাঁর অসুবিধা হয় না। আমরা, দর্শকরা দেখি, কড়ক সিংয়ের স্মৃতি থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে প্রায় এক যুগ। সেই স্মৃতির পুনর্নিমাণের দায়িত্ব শুধু তাঁর মেয়ে সাক্ষী, বান্ধবী নয়না, কলিগ অর্জুন বা হেড নার্সের নয়; সে-দায়িত্ব দর্শকেরও। প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা গল্প আছে। সেই বাস্তবতা থেকে নির্মিত হচ্ছে বৃহত্তর এক বাস্তবতা, যা কিনা কড়ক সিংয়ের গল্প, এবং তা নানাভাবে সম্পাদিত হয়ে তৈরি হচ্ছে দর্শকের মনেই। শেষমেশ শুধু কড়ক সিং-এর সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলিয়ে নিলেই হবে। এ সিনেমার থ্রিল আসলে সেখানেই। আর সেই থ্রিলের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েই পরিচালক আমাদের পৌঁছে দেন পঞ্জি স্কিমের দুনিয়ায়। পৌঁছে দেন ঘটিবাটি চাঁটি হওয়া সর্বহারার কাছে। এই দুর্নীতি কেবল চালচিত্র হয়ে আসে না। এক এক করে চিহ্নিত করতে থাকে কাহিনির ভিতরকার দ্বন্দ্ব-জন্মের মুহূর্তগুলিকে– দুর্নীতি, ক্ষমতাবানের মুখ ও মুখোশ এবং একজন ‘ইমানদার’ অফিসারের মনের ভিতরকার উথালপাতাল। ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানো সেই শুরু। বিস্মৃতির বিপ্রতীপে স্মৃতির পুনরুদ্ধারেই দর্শকের কাছে তা ক্রমশ প্রকাশিত। বোঝা যায়, পরিচালক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র বলছেন না। বলছেন এক ধারাবাহিকতার কথা। দুর্নীতি, শোষণ, ক্ষমতার মার- তার একটা দিক। অন্যদিকে আছে কড়ক সিং-এর গল্প। একদিকে ক্ষমতাবানের রক্তচক্ষু, অন্যদিকে তা উপেক্ষা করেই একদিন খুলে দেওয়া ক্ষমতার সততা নামক ভণিতার মুখোশ। এইদিকের গল্পটা সাধারণ মানুষ। ইতিহাসের এ এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়াই। কড়ক সিং এসেছেন সেটুকুই ধরিয়ে দিতে। ফলে, সিনেমা যত এগোয় তত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই প্রশ্ন যে, কড়ক সিং সত্যিই কি সব ভুলে গিয়েছেন, নাকি তাঁকে সব ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে? যদি তাই-ই হয়ে থাকে, তাহলে সে কাজ করল কারা? সিনেমা যাকে থ্রিলারের মোড়ক দিয়েছে, তা যেন আখেরে আমাদের বেঁচে থাকার খোঁজ। তা ইতিহাসেরও গূঢ় সন্ধান বইকি! সমসময়ের বিভ্রান্তিকে অদৃষ্ট হিসাবে মেনে নিলে কিছু করার নেই। তখন বিপর্যয়ই সত্যি। তবে যদি প্রশ্নগুলো ঠিকঠাকভাবে করা যেত, আমাদের সামূহিক বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির জাগরণ যদি সম্ভব হত, তাহলে ওই ভুলিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাবান পান্ডাদেরও চিহ্নিত করা যেত। কড়ক সিং তাই আদ্যন্ত রাজনৈতিক, এবং তাই-ই হওয়া উচিত।
কড়ক সিং আমাদের হাসায়, কাঁদায়, সবথেকে বড় কথা ভাবায়। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর এ-সিনেমা দেখতে ভালো লাগে। চমৎকার অভিনয় করেছেন প্রত্যেকেই। কড়ক সিং পঙ্কজ ত্রিপাঠী স্বভাবতই মুখ্য ভূমিকাটি পালন করেছেন। তবে তাঁর অভিনয় যে পরতে পরতে বদলে গিয়েছে, তা মূলত তিন নারীকে কেন্দ্র করে। সেখানে সঞ্জনা সঙ্ঘী (মেয়ে), পার্বতী তিরবোথু (নার্স) এবং জয়া আহসান (বান্ধবী) অনবদ্য। নয়না হিসাবে জয়ার অভিনয়ের অংশ কমই। তবে নয়না আর কড়ক সিং-এর সম্পর্কের রসায়নের ভিতরে দিয়ে আরও এক ক্ষমতার কাঠামোকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন পরিচালক। অনবদ্য এক শব্দবন্ধ উঠে এসেছে এখানে, ‘পলিটিক্যাল ইনকারেক্ট সেক্স’। চলতি কথায় এ সবকেই আমরা ‘অবৈধ’ বলে দাগিয়ে দিই। যে-সম্পর্কের নাম নেই, তার জায়গাও নেই সামাজিক সংসারে। অথচ নামযুক্ত সম্পর্কের ভিতরও তো চলে ভণিতা, প্রভুত্বের খেলা। ফলে, পলিটিক্যালি কারেক্ট হয়ে থাকার অসারতা আর গোপন থাকে না। পঙ্কজ এবং জয়া, দুই তুখোড় অভিনেতাকে এক ফ্রেমে নিয়ে এই সঙ্গম-পরবর্তী দৃশ্যটির ভিতর যে নান্দনিকতা ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক, তা নিশ্চিত পরবর্তী কালে রেফারেন্স হিসাবে কাজ করবে। এই আলফা মেল, টক্সিক ম্যাসকুলিনিটির সেলিব্রেশনের দিনকালে এরকম একটা দৃশ্য শুধু স্বস্তি দেয় না, ভরসাও জোগায়। বোঝায়, সহজের ভাষা আজও ভুলে যায়নি সিনেমা। পার্বতী তিরবোথু আর পঙ্কজকে নিয়েও অনবদ্য দৃশ্য রচনা করেছেন পরিচালক। দুঃখবোধ, যৌনতা পেরিয়ে সেখানে এক অনাবিল ভালোবাসার সম্পর্ক। একেবারে শেষের দিকে দুই অভিনেতাকে মুখোমুখি রেখে যে বিদায়দৃশ্যটি উপহার দিলেন অনিরুদ্ধ, তাকে শেষের কবিতাই বলা যায়। আর সঞ্জনাকে সঙ্গে নিয়ে পঙ্কজ বলে গেলেন তার পুরো গল্পটি। ফলত এই সম্পর্কে অনেক চড়াই-উতরাই, বহু নাটকীয়তা। তবে তা উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি। আসলে গোটা ছবিটাই তার রাজনৈতিক বয়ানকে সঙ্গে নিয়েও উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি। শান্তনু মৈত্রের সঙ্গীতের ভিতরও সেই কথাটি খুব স্পষ্ট।
কড়ক সিং তবু শেষ পর্যন্ত ফিল-গুড ছবি হয়ে থাকে না। তা ভাবায় বলেই নাছোড় প্রশ্নের ছোবল ছেড়ে দেয় দর্শকের মনে। যে-প্রশ্ন কড়ক সিং-কে ব্যতিব্যস্ত করেছে, বিপর্যয়ের মুখে এনেও দাঁড় করিয়েছে। স্পয়লার দিয়ে বলা যায়, কড়ক সিং মারা গেলেও যেতে পারতেন। তবে তাঁকে মারা যে যায় না সেইটাই আসলে ইতিহাসের সত্যি। দুনিয়াদারি দুর্নীতিতে ছেয়ে আছে, তবু পৃথিবীটা যে ঘুরছে তা এই কড়ক সিং-দের জন্যই। তাঁদের সততার জন্যই। ক্ষমতার উপরকাঠামোয় বসে থেকে সততার ভাণ করে যাওয়া অযোগ্যদের দরুন নয়। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সময় লাগে। স্মৃতির পুনরুদ্ধারেও সময় যায়। তবে আখেরে কোনও আন্দোলন কিংবা সংগ্রামই ব্যর্থ হয় না। ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করতে সময়ে সময়ে একজন-না-একজন কড়ক সিং তাই সর্বত্র থেকেই যান। যিনি আমাদের সম্মিলিত বিস্মৃতির প্রতিনিধি হয়ে, স্মৃতি ও সংগ্রাম জাগিয়ে তুলতে পারেন। সততা তাঁর ভিত্তি, আর মার খেতে খেতে জিতে যাওয়াই তাঁর ভবিষ্যৎ। সেই কড়ক সিং-কে কি আমরা আয়নায় দেখতে পাই? সিনেমা সোচ্চারে এ-প্রশ্ন করে না। তবু এই প্রশ্ন আছে বলেই এ ছবির নাম ‘কড়ক সিং’। নইলে তা কোনও এক এ.কে শ্রীবাস্তবের গল্প হয়েই থেকে যেত।
ছবি- কড়ক সিং
পরিচালক- অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী
অভিনয়- পঙ্কজ ত্রিপাঠী, সঞ্জনা সঙ্ঘী, পার্বতী তিরবোথু, জয়া আহসান
সংগীত- শান্তনু মৈত্র