পুজো দিলেই দিতে হবে প্রণামী। কোথাও আবার নির্দিষ্ট টাকা না দিলে, দেবতার দর্শনই মিলবে না। দেশের অধিকাংশ মন্দিরেই এমন নিয়ম রয়েছে। ব্যতিক্রম উত্তর ভারতের এই শিবমন্দির। সেখানে প্রণামী দেওয়াই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সেই মন্দিরের খোঁজ নিলেন শুভদীপ রায়।
পাড়ার শিবমন্দির হোক, কিংবা বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র, মন্দিরের সামনে দানবাক্স দেখতে পাওয়া একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার। অস্থায়ী পুজো প্যান্ডেলেও প্রণামী বাক্স ঠিক চোখে পড়ে। তবে এই মন্দিরের চারিদিক তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও দানবাক্স চোখে পড়বে না। বরং, মন্দিরে ঢুকলেই চোখে পড়বে বড় বড় হরফে লেখা সতর্ক বাণী। লেখা রয়েছে, ‘সাবধান! এই মন্দিরে প্রণামী দেওয়া নিষিদ্ধ’।
আরও শুনুন: বিদেশের ‘অযোধ্যা’ থেকে আসছে মাটি, মিশে যাবে দেশের রাম মন্দিরে
ভাবছেন তো, এমনটা আবার হয় নাকি! শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি। দেরাদুনের এই শিবমন্দিরে গেলে চোখে পড়বে এমনই দৃশ্য। চারিদিক পাহাড় ঘেরা মনোরম পরিবেশে এক মন্দির, যেখানে প্রণামী দেওয়া কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কথা বলছি, প্রকাশেশ্বর মহাদেবের মন্দির সম্পর্কে। দেরাদুন শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে মুসৌরি যাওয়ার পথে এই মন্দির চোখে পড়ে। বলা যায়, এই মন্দিরের সামনে দিয়েই মুসৌরির উদ্দেশে উপরের দিকে উঠতে থাকে পর্যটকদের গাড়ি। কেউ যাওয়ার আগে, কেউ বা ফেরার পথে, এই মন্দিরের সামনে অবশ্যই একবার গাড়ি থামান। তারপর মন্দিরে ঢুকে ভক্তিভরে প্রকাশেশ্বর মহাদেবের দর্শন সারেন। শুধু তাই নয়, মন্দিরের ভিতর বিশ্রাম নেওয়ার যথেষ্ট জায়গা রয়েছে। অনেকেই সেখানে বসে পড়েন পথের ক্লান্তি দূর করতে। আর সেই ক্লান্তি আরও মেটায়, বাবার প্রসাদ গরম গরম দুধ চা। সাধারণত মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে চা দেওয়ার কথা শোনা যায় না। তবে প্রকাশেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে গেলে সবসময় ধোঁয়া ওঠা চা পাবেন। তাও আবার বিনামূল্যে। নির্দিষ্ট জায়গায় পাত্র রাখা থাকে। নিজেকেই সেসব ধুয়ে নিতে হয়। তারপর চা খেয়ে আবার ধুয়ে মুছে রেখে দিতে হবে।
শিবলিঙ্গটি স্ফটিকের। যা আকারে বেশ বড়। গর্ভগৃহ ছাড়াও দুটি শিবলিঙ্গ রয়েছে মন্দিরের চাতালে। সেখানে যে কেউ জল ঢালতে পারেন। তবে কোনও কিছুর জন্যই খরচ করতে হবে না একটি টাকা। মন্দিরের কোথাও চোখে পড়বে না দানবাক্স। শুধু দেওয়াল জুড়ে বিভিন্ন ভাষায় লেখা প্রণামী না দেওয়ার সতর্ক বাণী। বলা ভালো, এই মন্দিরে পুজো দেওয়ার যেন এটাই নিয়ম।
আরও শুনুন: মহিলা পুলিশের স্তন্যদান ভাইরাল, আরও যে যে কাজে নজর টেনেছে ভারতীয় পুলিশ
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই নিয়মের নেপথ্যে কারণ কী?
মন্দিরে থাকা পুরোহিতদের জীজ্ঞাসা করলে অদ্ভুত এক উত্তর মেলে। তাঁদের কথায়, যে ঈশ্বর আমাদের সবকিছু দিয়েছেন, তাঁকে দান করার সাধ্য আমাদের কই। তাঁরা আরও বলেন, এই যে আমরা হাসছি, ঘুরছি, ভালো জামা কাপড় পরে রয়েছি, সবই তো পরমপিতার দান। তাই তাঁরই দেওয়া জিনি তাঁকে দান করার কোনও মানে হয় না। টাকা পয়সার প্রসঙ্গেও একই উত্তর দেন মন্দিরের সেবায়েতরা। তাই এই মন্দিরে যেন কেউ কিছু দান না করেন সেই সতর্ক বার্তা চারিদিকে লেখা রয়েছে। যদিও স্থানীয়দের দাবি, এই মন্দির পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন কোনও ধনকুবের। যিনি একেবারেই চান না তাঁর পরিচয় প্রকাশ্যে আসুক। মন্দিরের বিনামূল্যে প্রসাদ বিতরণ থেকে শুরু করে, যাবতীয় খরচের দায়ভার তাঁরই। আর কাজ তিনি অত্যন্ত গোপনভাবে করতে চান বলেই দাবি অনেকের। তাঁর নির্দেশেই মন্দিরে দান না করার নিওম চালু হয়েছে। যে কোনও ভক্ত যেন মন্দিরে এসে প্রাণভরে দেবতার দর্শন করতে পারেন এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি এমনটা করেছেন বলেও শোনা যায়। আবার কেউ কেউ বলেন, এর নেপথ্যে কোনও একজন ব্যক্তি নয়, বরং কয়েকজন রয়েছেন। যাঁদের কেউই প্রকাশ্যে আসতে চান না। তবে কারণ যাই হোক, ভক্তদের কাছে এই মন্দির বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছে বিভিন্ন কারণে।
দান করা বা না করা নিয়ে বিশেষ মাথা না ঘামালেও, এখানে যে চা পাওয়া যায় তা নিয়ে বেশ আগ্রহ রয়েছে অনেকেরই। একে তো ঠাণ্ডার জায়গা, তার ওপর প্রসাদ হিসেবে ওমন সুন্দর চা বেশ লোভনীয়ও বটে। বিশেষ উৎসবে চায়ের সঙ্গে লুচি, হালুয়া জাতীয় প্রসাদও দেওয়া হয়। কোনও নির্দিষ্ট মাপ নেই। যে যত খুশি নিতে পারে। তাই শিবরাত্রি কিংবা শ্রাবণ মাসে চোখে পড়ার মতো ভিড় হয় মন্দিরে। তাই দেরাদুন-মুসৌরি ভ্রমণের সময় অবশ্যই ঘুরে দেখা যেতে পারে প্রকাশেশ্বর মহাদেবের এই মন্দির। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন মুগ্ধ করবে, তেমনই তৃপ্তি মিলবে প্রসাদ হিসেবে পাওয়া ওই চা খেয়েও।