অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেওয়া বা তা নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনাই বা কতখানি রুচির পরিচয় দেয়? মনে রাখা ভালো, কেবল সময়ের নিরিখে নয়, আসলে মনোভঙ্গির বদলের প্রেক্ষিতেই তো মধ্যযুগ থেকে এক ধাপ এগিয়ে আধুনিক যুগ শুরু হয়েছিল। যে আধুনিক যুগ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণাকেই। সেই আধুনিকতার দুশো বছর পার করে এসে যদি ব্যক্তির স্বতন্ত্র নির্বাচন নিয়েই আমরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করি, তাহলে আমরাই বা আর কতটুকু এগোলাম? প্রশ্ন তুললেন রণিতা চট্টোপাধ্যায় ।
‘বন্ধুর বউ’। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও একজন নারীর পরিচয় আটকে থাকছে কেবলমাত্র এই শব্দবন্ধে। সম্প্রতি, পিয়া চক্রবর্তী এবং পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের বিয়ে উপলক্ষে নেটদুনিয়ায় বারেবারেই ফিরে এসেছে এই কথাটি। আক্রমণের বেশিরভাগটাই পরমব্রতর প্রতি। বলা হচ্ছে, তিনি ‘বন্ধুর বউকে বিয়ে করেছেন’। তা যে অন্যায়, সে নিদানও দেওয়া হয়ে যাচ্ছে। উঠছে বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগও। আর সে সবের আড়ালে যা চাপা পড়ে যাচ্ছে, তা হল, পিয়া চক্রবর্তী যখন পরমব্রতকে বিয়ে করছেন, তখন কিন্তু তিনি আর বন্ধুর বউ নন। এটি তাঁর পরিচয় হতে পারে না। অথচ আমোদের উৎসাহে এই একটা জায়গা ভুলেই গেল সোশ্যাল মিডিয়ার চণ্ডীমণ্ডপ। ফলে এই চাঁদের ওপিঠে পৌঁছানোর যুগে এসেও আমরা জানলাম, একজন নারীকে তাঁর বৈবাহিক পরিচয়ে চিহ্নিত করা ছাড়া আমরা আর-কিছু ভাবতেই শিখিনি।
যা শোনা যায়, তা অবলম্বন করেই ধরে নেওয়া যাক, পিয়া চক্রবর্তী কোনও এক সময় ছিলেন পরমব্রতর বন্ধুর স্ত্রী। সেই সম্পর্কটি স্থায়ী হয়নি। যে কোনও কারণেই হোক, আগের দাম্পত্যে তাঁরা একসঙ্গে থাকতে পারেননি কিংবা চাননি। আইনের পথে হেঁটেই বিচ্ছেদ হয়েছে তাঁদের। তার চেয়েও বড় কথা, সেই বিচ্ছেদকে উভয়েই মেনে নিয়েছেন। এবং অত্যন্ত মার্জিত ভাবে। কোথাও কেউ কারও বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেননি। দুজন পরিণতমনস্ক মানুষের থেকে যা কাম্য, তাই-ই তাঁরা করেছেন। সমস্যা হল, সেই পরিণতি এবং পরিমিতি বোধ গোটা সমাজের আয়ত্ত নয়। হওয়ার কথাও নয়। আর তার ফলেই, এক পক্ষকে ভিলেন আর অন্য পক্ষকে ভিক্টিম হিসেবে ভেবে নেওয়া আমাদের পক্ষে অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। এই বাইনারিতেই, পিয়া ও তাঁর আগের স্বামীর সম্মতিক্রমে আইনি বিচ্ছেদ চাপা পড়ে গিয়েছে। তাই তার পরেও একজন স্বাধীন, সফল, স্বনির্ভর মহিলার পরিচয় আটকে থাকছে তাঁর প্রাক্তনের স্ত্রী হিসেবেই। আর পিয়া এবং পরমব্রতর বিয়ে হয়ে দাঁড়াচ্ছে ‘বন্ধুর বউ’-কে নিয়ে পালানোর শামিল, যা শুনে মনে হচ্ছে এক পুরুষের নাগালে থাকা সম্পত্তি আরেক পুরুষ দখল করেছেন মাত্র। দুই পুরুষের মাঝে মহিলাটি যেন একেবারেই অস্তিত্বহীন হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। কেননা একজনের বন্ধুর বউ থেকে তিনি বউ হয়ে উঠছেন মাত্র। তাঁর আর আলাদা কোনও পরিচয় নেই।
আরও শুনুন: লোকে কী ভাববে! আর ভাবছেন না ভারতীয় মহিলারা, সিঙ্গল থেকেই খুঁজে নিচ্ছেন সুখ
এই ঘটনায় বিশ্বাসভঙ্গের প্রশ্নটিও আসছে। এ কথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, বন্ধুত্বই হোক কি প্রেম, যে কোনও সম্পর্ক আদতে দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বাসের উপরেই। সেই বিশ্বাসে চিড় ধরলে মানুষের ভেতরে ভাঙনের শব্দ হয়। কোনও কারণে বা অকারণে একটি সম্পর্কে আর থাকা গেল না, এ ঘটনা যতখানি বেদনার, সেই বেদনাই অন্য তীব্রতা পেয়ে যায় যদি তাতে বিশ্বাসভঙ্গের দাগ লাগে। একজন মানুষ যখন তাঁর সঙ্গীর প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রাখছেন, সেই সময়েই তাঁর অজান্তে সেই সঙ্গী নিজেকে জুড়ে নিচ্ছেন অন্য কোনও মানুষের সঙ্গে, এমনটা আদতে তিনজন মানুষের কাউকেই সম্পূর্ণ সম্মান দেয় না। তেমনটা না হলেই হয়তো ভালো হত, কিন্তু মানুষের মনকে সত্যিই তো শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা চলে না। সুতরাং যদি এক সম্পর্কে থাকাকালীন কেউ অন্য কোনও মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং দ্বিতীয় সম্পর্কটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই চান, সেখানে আগের সম্পর্ককে জোর করে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা বৃথা। তাতে প্রথম মানুষটিকেও আদতে অসম্মানই করা হয়। তার থেকে বিগড়ে যাওয়া সম্পর্কে ইতি টেনে এগিয়ে যাওয়াই ভালো। এক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। সম্পর্কে বিশ্বাসঘাতকতা অবশ্যই খারাপ, খারাপ লাগার মতোই বিষয়। তা কেউ ‘বন্ধুর বউ’ হোন বা না হোন। তবু অসম্মানজনক সহাবস্থান থেকে সম্মানজনক প্রস্থান অনেক জরুরি। আর বিশ্বাস ভাঙার সমালোচনা যদি কেবল ‘বন্ধুর স্ত্রী’ হওয়ার উপরেই নির্ভর করে থাকে, তবে সে বিষয়টিও একইরকম ভাবে গোলমেলে। অথচ নেটদুনিয়ার সব আলোচনা, আমোদ, সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু ওই একটি জায়গাই।
আরও শুনুন: মণিপুর থেকে কান… কেন নগ্নতাকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তোলেন নারীরা?
তাহলে কি যাবতীয় নীতিবাগীশ কথার উৎস গিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে নারীর উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার বয়ানেই? অথচ এ কথা তো না মেনে উপায় নেই যে, যে-কোনও সম্পর্কেই দু-নৌকায় পা দিয়ে না চলাটা সম্মানের, উভয়ত। আর সেই সিদ্ধান্তের পর একজন স্বতন্ত্র ব্যক্তিমানুষ কী করবেন, সেটাও তাঁর নিজস্ব নির্বাচন। কথা হল, এই পরিস্থিতিতে মনোকষ্ট থাকবে বইকি, কিন্তু তা নিয়ে সালিশি সভা বসানো চলে না। অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেওয়া বা তা নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনাই বা কতখানি রুচির পরিচয় দেয়? মনে রাখা ভালো, কেবল সময়ের নিরিখে নয়, আসলে মনোভঙ্গির বদলের প্রেক্ষিতেই তো মধ্যযুগ থেকে এক ধাপ এগিয়ে আধুনিক যুগ শুরু হয়েছিল। যে আধুনিক যুগ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ধারণাকেই। সেই আধুনিকতার দুশো বছর পার করে এসে যদি ব্যক্তির স্বতন্ত্র নির্বাচন নিয়েই আমরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করি, তাহলে আমরাই বা আর কতটুকু এগোলাম?
অথচ এই নির্বাচনের বিষয়টিকে কিন্তু গুরুত্ব দিয়েছে ভারতের আইনও। তাই ঔপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসা পরকীয়া বিষয়ক আইনটিকে ২০১৮ সালেই বাতিল ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। বলে রাখা ভালো, ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৪৯৭ ধারা মোতাবেক কোনও পুরুষই কেবল, তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্কে লিপ্ত হওয়া পুরুষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারতেন, তাঁর সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে এই মর্মে। অন্যদিকে, ওই আইন বলবৎ থাকাকালীনও অপর পুরুষের স্ত্রীটির আইনি পথে হাঁটার উপায়, বা বলা ভালো এজেন্সি ছিল না। যদিও এই ধারা বাতিলের সময় সমাজের একটা বড় অংশেরই ধারণা হয়েছিল, এর ফলে পরকীয়া আইনসিদ্ধ হল। এই আইনটি নাকচ করার মাধ্যমে যে কেবল কোনও মেয়ের ‘স্বামীর সম্পত্তি’ হয়ে থাকার পরিচয়টি নাকচ করা হচ্ছে, সে কথা তাঁরা বুঝতেই চাননি, কারণ মেয়েদের ‘এজেন্সি’ কোনও না কোনও পুরুষের হাতে থাকাটাই তো নিয়ম। আমরা প্রগতিশীলতার পথে হাঁটি বলে মনে করি, কিন্তু আমাদের টান দেয় মনের অন্ধকার। আর তাই আজও একজন নারীর সঙ্গী নির্বাচন নিয়ে টানাটানি চলে তাঁর পূর্ব বিবাহিত জীবনেরই। আমরা গান গাই বটে, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’, কিন্তু অন্যকে অন্যের মতো থাকতে দেওয়ার মতো পরিণতি কি আদৌ হয়েছে আমাদের! সে কথাই বোধহয় ভেবে দেখার সময় এসেছে।