একটা মুহূর্তের অপেক্ষায় ছিলেন টানা ১৬ দিন। কখন অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসবে ছেলে, সেই প্রতীক্ষাতেই দিন কাটছিল বৃদ্ধের। অথচ যখন তা সম্ভব হল, তখন আর দেখা হল না। তার আগেই ফুরিয়েছে তাঁর আয়ু। ছেলের উদ্ধারের খবর জেনে যেতে পারলেন না বাবা। উদ্ধারের সাফল্যের মধ্যেই নেমে এল মর্মান্তিক বিষাদ। আসুন শুনে নিই।
অপেক্ষা করছিল গোটা দেশ। অপেক্ষা করছিলেন তিনিও। ৭০ বছরের বসিত মুর্মু। ছেলে ভক্তু মুর্মু আটকে পড়েছিলেন উত্তকাশীর সিল্কিয়ারার সেই কুখ্যাত টানেলে। এক একটা দিন কাটছিল। আর উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছিল। শেষমেশ যখন মুক্তির আলো দেখা গেল, হাসি ফুটল দেশের মুখে, সেদিনই প্রয়াত হলেন বৃদ্ধ।
আরও শুনুন: বন্দিদের মন বদলাবে হনুমান চালিশা পড়লেই, নয়া পদক্ষেপ যোগীরাজ্যে
উত্তকাশীতে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধার করতে সর্বোচ্চ পর্যায়ে চেষ্টা চালাচ্ছিল প্রশাসন। বিদেশ থেকে এসেছিলেন বিশেষজ্ঞ। আনা হয়েছিল বিশেষ যন্ত্রও। সুড়ঙ্গের মধ্যে থাকা শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করাও সম্ভব হয়েছিল। পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছিল খাবার-দাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস। ৪১ জন ছিলেন আটকে। তাই শ্রমিকদের মনোবল ভাঙেনি। শারীরিক অসুবিধা হচ্ছিল বটে, তবে বিশ্বাস ছিল, একদিন না একদিন ঠিক তাঁদের উদ্ধার করা হবে। এদিকে উদ্ধারকাজ যত এগিয়েছে উদ্বেগের পারদও তত চড়েছে। এক সময় যন্ত্র ভেঙে যায়, বিলম্বিত হয় উদ্ধারকাজ। তখন বিশেষ পদ্ধতিতে হাতে খোঁড়া শুরু হয়। সেই উদ্বেগের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেননি বৃদ্ধ। বাবার মন তো! প্রায় এক পক্ষকাল জুড়ে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়েই ছিলেন। ছেলে কেমন আছে, কবে বাইরে আসতে পারবে, এই নিয়েই চিন্তিতি ছিলেন। তবু হাল ছাড়েননি। টানা ১৬ দিন অপেক্ষাতেই ছিলেন। অথচ আয়ু ফুরোল ঠিক সেদিনই, যেদিন তাঁর ছেলে-সহ একচল্লিশ জন শ্রমিক বেরিয়ে এলেন বাইরে। পরিবার সূত্রে জানা যাচ্ছে, মঙ্গলবার সকালেই আচমকা খাটিয়া থেকে পড়ে যান তিনি । আক্রান্ত হয়েছিলেন হৃদরোগে। তা থেকে আর ফিরতে পারেননি। ইহকালের সব উদ্বেগ ফেলে রেখে পাড়ি দেন পরপারে। যে ক্ষণটির অপেক্ষা করছিলেন, তা এল সেসিনই সন্ধে নাগাদ। একে একে বেরিয়ে এলেন সকলেই। সেই আনন্দ-মুহূর্তের আর সাক্ষী থাকতে পারলেন না বৃদ্ধ।
আরও শুনুন: বোরখা পরেই র্যাম্পে হাঁটলেন তরুণীরা, ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগে সরব মুসলিম সংগঠন
পরিবারের অন্যান্যরা জানাচ্ছেন, ছেলের চিন্তাতেই দিন কাটত বাবার। গত ১৬ দিন ধরে একবার করে আশার আলো জ্বলেছে, পরক্ষণেই কোনও এক বিপর্যয়ে তা নিভে গিয়েছে। কী যে হতে পারে, তা যেন ভাবাই যাচ্ছিল না। টানাপোড়েন যত বেড়েছে তত বিষাদে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন তিনি। ট্রমা গ্রাস করছিল তাঁকে। সেসবই এক সময় তাঁকে ঠেলে দিল হৃদরোগের দিকে। তার উপর পড়ে যাওয়ার দরুন মাথায় চোটও ছিল। সব মিলিয়ে আর ফেরা হল না বৃদ্ধের। প্রশাসনের তরফ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার দিন দু-তিন আগে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। আশ্বস্ত করেছিলেন, ভরসাও দিয়েছিলেন। সে সময় ভালই ছিলেন বসিত। তবু শেষরক্ষা হল না। ছেলেকে শেষবার চোখের দেখাও হল না। অন্তহীন চিন্তার সুড়ঙ্গে আটকে থেকে শেষমেশ চলেই গেলেন বৃদ্ধ বাবা। আনন্দ আর বিষাদের ছায়া যেন একই সঙ্গে নেমে এসেছে গোটা পরিবারের উপরেই।