শেষ যেবার ভারতের হাতে বিশ্বকাপ উঠেছিল, সেই ২০১১ সালে, সেবার দূর থেকে খেলা দেখছিলেন রোহিত শর্মা। মাঠে নেমে ব্যাট করা তো দূর অস্ত, দলেই জায়গা হয়নি তাঁর। সেদিনের বাদ-পড়া যুবক এবার দেশকে আরেক বিশ্বকাপ জয়ের দোরগোড়ায় হাত ধরে পৌঁছে দিয়েছেন। তাই কামব্যাকের অন্যরকম এক বয়ান এবার লিখতে পারেন তিনিই।
ভীষণ, ভীষণ হতাশ লাগছে। বিশ্বকাপ স্কোয়াডে জায়গা হল না। কিন্তু এখান থেকে এগিয়ে যেতেই হবে। – ২০১১ সালের বিশ্বকাপের দলে জায়গা না পেয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এভাবেই হতাশা প্রকাশ করে ফেলেছিলেন রোহিত শর্মা। বছর চব্বিশের ঝকঝকে তরুণ তার ঠিক চার বছর আগে জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন। যে কোনও পিচে বোলারকে পালটা মারার ক্ষমতা দেখিয়ে নজরও কেড়েছেন। তাঁর প্রতিভা আছে এ কথা মেনে নিতে কারও সমস্যা ছিল না। কিন্তু প্রতিভা খেলতে আসে, আর প্রতিভা প্যাভিলিয়নে ফেরত যায়, এমন নজিরও যে ভূরি ভূরি রাখতে শুরু করেছিলেন রোহিত। প্রতিভা আছে, কিন্তু ধারাবাহিকতা নেই যখন, বিশ্বকাপের দলে এহেন ব্যাটারকে রাখায় মত হল না প্রশাসকদের। অনিবার্য ফল, ২০১১ সালে যখন ট্রফি হাতে নিয়ে চওড়া হাসছেন শচীন-মাহি, জয়ের মুকুট মাথায় পরছেন তাঁর সতীর্থরা, তখন সব আলোর থেকে দূরে বসে আছেন রোহিত। আফসোসে ছটফট করছেন, আর একইসঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করছেন, এখান থেকে এগিয়ে যেতেই হবে। মুভ অন-এর মন্ত্রটা বোধহয় সেদিনই ঝালিয়ে নিয়েছিলেন রোহিত। তিনি জানতেন, মুভ অন না করলে কামব্যাক করা যায় না।
আরও শুনুন: কোহলি-শামি একসঙ্গেই লেখেন দেশের রূপকথা, বিশ্বকাপ ফুরোলে দেশবাসী মনে রাখবে তো?
কাট টু ২০২৩। ঠিক বারো বছর সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে আছেন রোহিত শর্মা। দেশের জার্সি গায়ে, দেশের ক্যাপ্টেন। একদিন যে জয়ের প্রত্যক্ষ শরিক হতে পারেননি, আজ তাঁর হাত ধরেই ফের সেই জয়ের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে দেশ। একের পর এক ম্যাচে নিজের ‘হিটম্যান’ তকমার প্রতি ন্যায়বিচার করে চলেছেন রোহিত। একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেওছেন ইতিমধ্যে, ম্যাচের গোড়াতেই সুর বেঁধে দিতে চান তিনি। সত্যিই, ব্যক্তিগত রেকর্ডকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে রোহিত যেভাবে প্রথম থেকেই দলের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দিয়েছেন, সেই সুচিন্তিত স্ট্র্যাটেজিকে গুরুত্ব না দিয়ে উপায় নেই।
আসলে মুম্বইয়ের সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা রোহিত যে জানেন, কামব্যাক করতে গেলে শুধু পালটা দিলেই হয় না, সেই পালটা দিতে হয় হিসেব করেই। বাবার সামান্য চাকরির দরুন তাঁর ছোটবেলা কেটেছে ঠাকুমা-দাদুর কাছে, একলা। স্কুলের ফিজ দিতেই সমস্যা হত, সেখানে ক্রিকেট প্র্যাকটিস! তারপরেও তো লড়াইটা চালিয়ে গিয়েছেন। ক্রিকেট কিট কিনতে পারেননি, কাজ চালিয়ে নিয়েছেন অ্যাকাডেমির ফেলে দেওয়া সাজসরঞ্জাম দিয়েই। দেওধর-রঞ্জিতে দুরন্ত খেলার সুবাদে জাতীয় দল অব্দি রাস্তা খুলে গেল, তারপরেও সমালোচনার ঝড়। খেলার দুনিয়ায় যে কেবল প্রতিভা থাকলেই চলে না, তার সঙ্গে পরিকল্পনাটাও সমান প্রয়োজন, সে কথা রোহিতকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে সময়। বিরাট কোহলির হাত থেকে ক্যাপ্টেন্সির ব্যাটন হাতে আসার পরেও কম নিন্দেমন্দ হয়নি। কোহলির সঙ্গে কর্তৃপক্ষের সংঘাত, তাঁর আকস্মিক ক্যাপ্টেন্সি থেকে সরে যাওয়া, এর সবটাই সবার চোখের সামনে ছিল। ফলে যতবার অধিনায়ক হিসেবে রোহিত ভুল করেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন, সেই ক্ষোভ তাঁর উপরেই উগরে দিয়েছেন বিরাট-ভক্তরা। তার উপর দিনের পর দিন রান না পাওয়ার চাপ। কে জানে, ‘হিটম্যান’ তকমাটা সেসময় রোহিতের দিকে তাকিয়ে মুখবিকৃতি করত কি না!
আরও শুনুন: টক্করের মাঝেও প্রতিপক্ষের দিকে সাহায্যের হাত ঈশানের… যুদ্ধ ছাপিয়ে ভালোবাসার নাম ক্রিকেট
কিন্তু রোহিত তো জানতেন, সেই ২০১১-র জায়গাটা তাঁকে পালটে ফেলতেই হবে। মুভ অন করতেই হবে তাঁকে। আর তিনি সেটাই করেছেন। একসময় ধারাবাহিকতা নেই বলে যিনি বিশ্বকাপের দলে জায়গাই পাননি, আজ তাঁকে নিয়েই কোনও ধারাভাষ্যকারকে বলতে হয়, “If Sharma starts playing in his own form, no super power can stop India from winning the world cup…”
কামব্যাকের গল্পে রোহিত শর্মা, তুলনারহিতই বটে!