বাংলার বিনোদনের দুনিয়ার চলতি অভ্যাস, নামের সঙ্গে ‘কুমার’ জুড়ে নেওয়া। ময়ূরপুচ্ছের মতো, ওই উপাধিতেই যেন লেগে আছে সাফল্যের সবটুকু আলো। তাই গান থেকে সিনেমা থেকে যাত্রা, তারকাদের নামে ‘কুমার’-এর ছড়াছড়ি। কিন্তু সাহিত্যে? সেখানে তিনি একক। এক এবং অদ্বিতীয়। তিনি স্বপনকুমার।
সেসময়ে গানের দুনিয়া মেতে উঠেছে কিশোর কুমারের সুরে। শুধু রেকর্ডিং স্টুডিওতেই নয়, ফিল্ম স্টুডিওতেও সাফল্যের মুকুট মাথায় পরেছেন এই নায়ক। বলিউডে অবশ্য একা কিশোরকুমার নন, ‘দাদামণি’ অশোককুমারও রয়েছেন তখন। মহম্মদ ইউসুফও নাম পালটে নিজেকে চিনিয়েছেন দিলীপকুমার নামে। আর বাংলা সিনেমহলে? অনুপকুমার, তরুণকুমার… আর সর্বোপরি, উত্তমকুমার। বাঙালির স্বপ্নের নায়ক। যাত্রার কথা তো বলাই বাহুল্য, সেখানে সবসময়েই প্রায় নায়কের নামের সঙ্গে কুমার জুড়ে থাকে, সে তিনি যুবক থেকে প্রৌঢ় যে বয়সেরই হোন না কেন। অথচ শিল্পের পাশাপাশি যদি সাহিত্যের দিকে তাকানো যায়? সেখানে কোনও কুমারটুলি নেই। বাংলা সাহিত্যের আকাশে একাধিক চাঁদ, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে শরৎচন্দ্র থেকে বলাইচাঁদ- কে নেই! কিন্তু কুমার, নৈব নৈব চ। কে জানে, এই শব্দের সঙ্গে চলতি বিনোদনের বড় সহজ যোগ বলেই কি সেকালের সারস্বত সমাজ তাকে এড়িয়ে চলেছিল? উত্তর মেলে না। কিন্তু সেই উত্তর খুঁজতে গিয়ে মিলে যায় একজনের হদিশ। সেকালের সুকুমার সারস্বত সমাজের শান্ত স্থৈর্য ভেঙে যিনি ঢুকে পড়েছিলেন আচমকাই। ‘কুমার’ শব্দের মতোই, তিনিও সেই সমাজের চলতি গতে বাঁধা নন। বাংলা সাহিত্যের একমাত্র ‘কুমার’ তিনিই। একমেবাদ্বিতীয়ম স্বপনকুমার।
আরও শুনুন: সাত ভাই চম্পা বা অরুণ-বরুণ-কিরণমালা, বোনের ভাইকে আগলে রাখাই বাঙালির রূপকথা
গোয়েন্দা-রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় বরাবরই শেষ বেঞ্চের বাসিন্দা। তার উপরে স্বপনকুমার যে গোয়েন্দার আমদানি করেছিলেন, সে বুদ্ধি বা যুক্তি কোনও কিছুরই বিশেষ ধার ধারে না। এক হাতে উদ্যত পিস্তল, অন্য হাতে জ্বলন্ত টর্চ নিয়েও পাঁচতলা বাড়ি থেকে স্রেফ জলের পাইপ বেয়ে নেমে আসে দীপক চ্যাটার্জি। ড্রাগন সিরিজ, বাজপাখি সিরিজ, কালনাগিনী সিরিজ- দীপককে নিয়েই রহস্যরোমাঞ্চ গল্পের একের পর সিরিজ লিখেছিলেন স্বপনকুমার। কুড়িটা সিরিজ। কয়েকটা সিরিজে একশোর কাছাকাছি বই। ক্লাসিক সাহিত্যের শীল এবং শ্লীল দুনিয়ার বাইরের যে আমপাঠকের জগৎ, সেখানে রমরমিয়ে বিকোত স্বপনকুমারের এইসব চটি বই। যার প্রচ্ছদে নারীচরিত্রগুলো আবার বিশেষ যত্ন নিয়ে আঁকা, পাঠকের কাছে তা ছিল বাড়তি নিষিদ্ধ আকর্ষণ। আর এ সবের সঙ্গে ছিল স্বপনকুমারের হুড়মুড়িয়ে গল্প বলার স্টাইল। কোথাও এক মুহূর্ত না থেমে স্রেফ একের পর এক ঘটনার ঘনঘটা। শুধু তাঁর গল্পের হিরো নয়, কখনও কখনও তাঁর ভিলেনও ন্যায়বিচারের প্রতীক। যে ডাক্তার ভ্রূণহত্যার মতো অনৈতিক কাজ করে, যে কালোবাজারি প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে মানুষের রক্ত চোষে, যে গোপনে জাল নোটের ব্যবসা চালায়, তাদের ‘প্রাণদণ্ড’ দেয় ভিলেন। সভ্য ভদ্র সমাজের নাগরিক গোয়েন্দা, যে গল্পের নায়ক, সে সমাজের ওই ‘শত্রু’-দের সুরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। বাস্তবে না হোক, গল্পে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। মনে রাখতে হবে, সময়টা ষাট-সত্তরের দশক। যখন আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে হাততালি কুড়োচ্ছেন ‘অ্যাংরি ইয়াং ম্যান’। রোজকার দুনিয়ায় মার খাওয়া সাধারণ মানুষ নিয়তি বোঝে না, কার্যকারণ সম্পর্ক বোঝে না, সে বোঝে পালটা মার। আর সেই মানুষের পালস বুঝেছিলেন স্বপনকুমার। তিনিই কেবল জানতেন সেই জাদু-ফরমুলা, যা পাঁচ দশক ধরে আম বাঙালিকে চটজলদি মনোরঞ্জনের খোরাক জুগিয়েছে। বাস্তববর্জিত, ‘এসকেপিস্ট’ বিনোদনসর্বস্ব পাল্প ফিকশন তাঁর আগে-পরে বা সমসময়েও অনেকেই লিখেছেন, দ্বিতীয় ‘স্বপনকুমার’ কিন্তু আর কেউ হননি।
আসলে গোটা জীবন জুড়েই গতের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন এই মানুষটি। আসল নাম সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে। আইনজীবী পরিবারে জন্ম, রাজশাহীর আদি ভিটে ছেড়ে এসেছিলেন কলকাতায়। ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হয়েছিলেন আর জি কর মেডিকেল কলেজে। কিন্তু পড়া শেষ করার আগেই বাধা হয়ে দাঁড়াল দারিদ্র্য। সেসময়ে রোজগারের পথ খুঁজেছিলেন সদ্য যুবক, কোনোরকম ছুঁতমার্গ না রেখেই। এর পরই তাঁর ‘শ্রীস্বপনকুমার’ হয়ে ওঠা। আরেকদিকে দুহাতে লিখে চলা ডাক্তারি বই, মোটর ড্রাইভিং, ট্রানজিস্টর তৈরি থেকে সবজি চাষের বইও। জানা যায়, শিয়ালদা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে নিখরচায় আলো-পাখা পেতেন, সারা রাত ওখানেই বসে লিখে যেতেন। সকালে প্রকাশকের লোক এসে হাতে হাতে টাকা দিয়ে পান্ডুলিপি নিয়ে যেত। আবার রহস্য সিরিজের লেখক শ্রীস্বপনকুমারই জ্যোতিষী শ্রীভৃগু। প্রকাশক তাঁকে পাওনা টাকা না দিয়ে বসিয়ে রেখে জ্যোতিষের বই-লিখিয়ের হিসেব করছেন, সেই অপমানের জবাব দিতেই জ্যোতিষ শেখার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তিনি। নামমাহাত্ম্যে এক সময় শ্রীভৃগুরও একাধিক নকল বেরিয়ে গিয়েছিল বাজারে, নিজেকে এমনই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই মানুষটি।
আরও শুনুন: সমাজের অসংগতিকে বিঁধেছেন লাগাতার, কার্টুনের ইতিহাসে অনন্য এক প্রতিষ্ঠান অমল চক্রবর্তী
কোনোরকম চেনা গতে তাঁকে ধরানো যায় না আসলে। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎ এমন মানুষকে মনে রাখতে অস্বস্তিতে পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। তাই স্বপনকুমার অনেকখানিই হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির অতলে। তবে বাংলা সাহিত্যের দুনিয়ায় ‘কুমার’ নামের মুকুট তাঁর একারই ছিল, পরবর্তী কালেও সে মুকুটের ভাগিদার হতে পারেননি আর কেউই। ওই নামের সঙ্গে যে আলো ঝলমলে সাফল্যের ছোঁয়া লেগে ছিল সেই সময়ের বাংলায়, সেই সাফল্যও তাঁর একারই।