কোন কথা যে কখন সত্যি হয়ে যায়, তা কে বলতে পারে! আর সে কথাই ভালোমতো টের পেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি কোনও দিন বলি-তারকা ওয়াহিদা রহমানের নায়ক হতে পারেন, এমনটা যখন ভাবতে পারেননি, সেইরকম এক সময়েই নেহাত মজার ছলে উঠে এসেছিল এমনই এক আশার কথা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক সে গল্প।
সিনেমার পর্দায় তাঁকে দেখলেই অনুরাগীদের শ্বাস থেমে যেত একসময়। তিনি, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সর্বার্থেই বাঙালির নায়ক। বাংলা সিনেমা তাঁর মধ্যেই একইসঙ্গে পেয়েছিল এক ম্যাটিনি আইডল এবং একজন শানিত অভিনেতাকে। এহেন এক নায়কের সঙ্গে তাই অনায়াসে জুটি বেঁধেছেন একের পর এক দাপুটে অভিনেত্রী। তার মধ্যে সুচিত্রা সেন, শর্মিলা ঠাকুরেরা যেমন রয়েছেন, তেমনই সৌমিত্রর সঙ্গে পর্দায় দেখা গিয়েছে বলিউডের চোখধাঁধানো নায়িকা ওয়াহিদা রহমানকেও। কিন্তু কথা হল, যে সময়ে সৌমিত্র এমন আকাশছোঁয়া খ্যাতি পাননি, তাঁকে দেখার জন্য তখনও ভিড় জমে ওঠে না রাস্তায়, সেই সময়েই আরেক বিখ্যাত মানুষ প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীই করে বসেছিলেন যে, ওয়াহিদার নায়ক হতে পারেন সৌমিত্র। তিনি কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। যদিও সে কথাকে তখন অসম্ভব ভাবনা বলে হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন সৌমিত্র। পরবর্তীকালে সেদিনের গল্প শুনিয়েছেন স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ।
আরও শুনুন: মৃত্যু, নাকি সুইসাইড! মহানায়কের প্রয়াণে কেন হাহাকার করে উঠেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়?
সেটা এমন এক সময়ের কথা, যখন সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’ আর ‘তিনকন্যা’-য় অভিনয় করে ফেলেছেন সৌমিত্র। পাশাপাশি থিয়েটার আর লেখালিখির জগৎ তাঁর নায়ক ইমেজে যোগ করেছে অন্য মাত্রা। সেইরকম এক সময়েই সৌমিত্রর সঙ্গে চলেছেন কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত আর শঙ্খ ঘোষ। গন্তব্য প্রেমেন্দ্র মিত্রর বাড়ি। গাড়ি চালাচ্ছেন সৌমিত্র, পাশের আসনে অলোকরঞ্জন আর পিছনের সিটে শঙ্খবাবু। আর সেই যাত্রার মাঝেই খ্যাতি নিয়ে অলোকরঞ্জনের খুনসুটি চলেছে সৌমিত্রর সঙ্গে। ‘শঙ্খবাবুর সঙ্গে’ বইয়ে তার বিবরণ এইরকম-
অলোকরঞ্জন তাঁর অনন্য শব্দ-সংলাপে বললেন, এই যে আমরা চলেছি এমন এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ অভিনেতার সঙ্গে, গৌরবান্বিতের গৌরবচ্ছটা গায়ে মেখে, এতে পথচলতি মানুষেরা আমাদের সৌভাগ্যের প্রতি ঈর্ষান্বিত নয়?
পালটা সৌমিত্র বললেন, আমি যে চলেছি অলোকরঞ্জনের মতো এক খ্যাতিমান কবির সঙ্গে? লোকে তো আমাকেই ঈর্ষা করছে।
আমাকে কে চেনে?
উত্তরে সৌমিত্রবাবু ঠাট্টা করে বলছেন: আমাকেই-বা কজন চিনছে? দেখছেন কি পথে তার কোনও চিহ্ন?
এমনই মনোরম বাকযুদ্ধের আমেজ নিতে নিতে শঙ্খবাবুর মনে হল, চলন্ত গাড়িতে সৌমিত্রকে দেখবার জন্য তেমন কোনও উন্মুখ উত্তেজনা না দেখে অলোকরঞ্জন বোধহয় খানিক আশাহতই হলেন। খানিক বাদে গাড়ি বড় রাস্তা ছেড়ে গলিপথ ধরতেই অলোকবাবু মহা উৎসাহে নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলে উঠলেন: এইবার… এইবারে দেখবেন গবাক্ষে গবাক্ষে উৎসুক কত অন্তঃপুরিকার ভিড়!
শঙ্খবাবুর মুখে এমনটা শুনে হেসে উঠলাম আমরা। না, অবশ্য এবারও তেমন কিছু ঘটল না। মরিয়া অলোকরঞ্জন বেশ আশাহত হয়ে বললেন, দিনেদুপুরে এত সহজে কি এই গলির মধ্যে দিয়ে যেতে পারতেন, যদি ধরুন এমন কোনও ছবিতে আপনি নায়ক আর হয়তো ওয়াহিদা রহমান নায়িকা?
ওয়াহিদা রহমান! হিন্দি সিনেমার বিখ্যাত নায়িকা অভিনয় করবেন বাংলা সিনেমার অভিনেতা সৌমিত্রর সঙ্গে! এমন একখানা অসম্ভব ভাবনার কথা শুনে গলা ছেড়ে হেসে উঠলেন সৌমিত্র। বললেন, একেবারে ওয়াহিদা! সত্যি, কল্পনার দৌড় বটে আপনার। একেই বলে কবি!
আরও শুনুন: ‘লবেঞ্চুস মার্কা হিরো’ নয়, নায়কের ধারণায় বদল আনার নায়ক সৌমিত্রই
পরবর্তীতে এ গল্প শুনিয়ে এইভাবে তার উপসংহার টানছেন শঙ্খ ঘোষ,
ওই ঘটনার কিছুদিন পর কাগজে খবর হল— সত্যজিৎ রায় তারাশঙ্করের ‘অভিযান’ নিয়ে নতুন ছবি করতে চলেছেন। যার অন্যতম নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আর নায়িকা? ওয়াহিদা রহমান! খবরটা জেনেই আমার প্রথমেই মনে পড়ল ওই কথাটা— একেই বলে কবি!
সত্যজিৎ রায়ের সেই কালজয়ী সিনেমায় সৌমিত্র-ওয়াহিদা জুটিকে পছন্দ করেছিলেন দর্শক, সে কথা আজ আর অজানা নয়। কিন্তু সেই ছবি হওয়ার আগেই যে এমন একটি আশার কথা বলে বসেছিলেন অলোকরঞ্জন, তা চমকে দেওয়ার মতোই।
[কৃতজ্ঞতা: শঙ্খবাবুর সঙ্গে, সৌমেন পাল। প্রকাশক সৃষ্টিসুখ]