সাত ভাই চম্পার সঙ্গে পারুল বোনের কথা উঠবেই। অরুণ বরুণের সঙ্গেও শোনা যাবে কিরণমালার নাম। মুনির কথামতো সাত রাজার ধন এক মানিক আনতে গিয়ে একের পর এক হারিয়ে গিয়েছেন দুই ভাই-ই। চোখের জল মুছে ঘর ছেড়ে বেরোলেন সবার ছোট বোনটি। দুর্গম পাহাড় থেকে অরুণ ও বরুণ দুই দাদাকে উদ্ধার করে আনলেন কিরণমালা বোনই। বোনের এমন করে ভাইকে আগলে রাখার গল্প বারে বারেই শোনা যায় বাংলার লৌকিক উচ্চারণে। ভাইফোঁটার প্রথাতেও কি আসলে তারই ছোঁয়া? খুঁজে দেখলেন রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
কোনও কিছু কামনা করে যে অনুষ্ঠান, তাকেই ব্রত বলা যায়। যেসব ব্রত শাস্ত্রীয়, তার অনেক নীতিনিয়ম, শুদ্ধতা রক্ষার দিকে তার নজর প্রখর। উলটোদিকে আবার রয়েছে এমন কিছু ব্রত, যেখানে পূজারি কিংবা মন্ত্র কিছুরই প্রয়োজন নেই, নিজের ভাষায় নিজের প্রার্থনাটুকু জানিয়েই সেই ব্রত সারেন মেয়েরা। ভাইফোঁটার যে আচার, তা প্রায় এই মেয়েলি ব্রতের মতোই। ধর্মীয় উৎসবের অনুষঙ্গেই এই প্রথা চলে আসছে এ কথা ঠিক, তবে তার মধ্যে যেন আরও কিছু কথা রয়ে গিয়েছে। ভাইফোঁটার মূল কথা ভাইয়ের আয়ু কামনা, ভাইকে ভালো রাখতে চাওয়া। ভাইয়ের কপালে দই চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে সেই প্রার্থনাই করেন বোনেরা- “যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা/ আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা/ আজ হতে ভাইয়ের আমার যমদুয়ারে পড়ল কাঁটা।” লৌকিক গল্প বলে, যমী বা যমুনার তপস্যার জোরে মৃত্যুর পরেও ফের বোনকে দেখা দিতে ফিরে এসেছিলেন যম। আর ভাইকে রক্ষা করার জন্য যমুনার সেই তাগিদকে ছুঁয়েই আজও ভাইয়ের দীর্ঘ আয়ুটুকু চেয়ে নেন আপামর বাংলার মেয়েরা। কার্তিক মাসে যে যমপুকুর ব্রত পালন করা হয় গ্রামবাংলায়, সেখানেও জুড়ে থাকে ভাই-সহ পরিবারকে ভালো রাখতে চাওয়া। আবার চৈত্র সংক্রান্তিকে বলা হয় ছাতু সংক্রান্তি, ভাইছাতু উৎসবের দিন। বাংলার ঘরে ঘরে এদিন ভাইয়ের হাতে বোনেরা তুলে দিত ছাতু। ‘ছাতু যায় উইড়্যা, দুশমন বাদী মরে পায়ের তলায় পইড়্যা’- এই কথা বলে রাস্তার তেমাথায় দাঁড়িয়ে ভাই সেই ছাতু ওড়াত পায়ের তলা দিয়ে। ভাইয়ের শত্রুদের এভাবে ছাতুর মতো উড়িয়ে দেওয়া হত, ভাইকে নিরাপদ রাখার জন্য। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বারে বারেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এভাবেই ভাইয়ের জন্য শুভকামনা জানিয়ে আসছেন বাংলার মেয়েরা।
আসলে ভাইকে এমন আগলে রাখতে চাওয়া তো কেবল অনুষ্ঠানেই আবদ্ধ নয়। বাংলার রূপকথার গল্পে কান পাতলে শোনা যায়, ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে’- ভাইদের মৃত্যুর মুখে সতর্ক করে দিচ্ছে পারুল বোন। ছোট রানির সাত ছেলে ও এক মেয়েকে পুঁতে ফেলেছিল অন্য রানিরা। তারাই ফুটে উঠেছিল ফুল হয়ে। মালি সে ফুল তুলে ফেললে যে তাদের প্রাণ থাকবে না আর, তা বুঝেই সাত ভাইকে বারে বারে জাগিয়ে দিয়েছে ছোট বোনটি। ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’-র গল্পেও যেমন, ছোট বোনের বুদ্ধিতেই পাথর থেকে ফের মানুষ হয়ে যান দুই রাজকুমার। এ নাহয় গেল রূপকথার গল্প। বাংলার সেকেলে ছড়া বলে- “ও পারেতে লঙ্কাগাছটি রাঙা টুকটুক করে/ গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে।” বাপের বাড়িতে ছেড়ে আসা ভাই কেমন আছে, সেকালের কিশোরী বউয়ের পক্ষে সে কথা জানার উপায় কোথায়! তাই হয়তো নিজের মনকে প্রবোধ দিতে সে ভাদুলি ব্রত করে, নদীর আলপনা এঁকে তার উপরে ফুল ধরে আকুল সুরে জানতে চায়- “নদী নদী! কোথায় যাও? / বাপ ভায়ের বার্তা দাও।” ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা এমনই, যে, কেবল ভাই থাকলেই যেন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে নেওয়া যায়। অন্তত সে কথাই বলছে পূর্ণিপুকুর ব্রত- “আমি সতী লীলাবতী, ভাইয়ের বোন ভাগ্যবতী”। ‘পথের পাঁচালী’-তে যে দুর্গা দস্যি মেয়ে, মেয়েলি কাজকর্মের কিছুতেই যার মন নেই, সেও কিন্তু মন দিয়ে পূর্ণিপুকুর ব্রত করতে বসে। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে ভাইকে জড়িয়ে রেখে সে প্রাণপণে আওড়ে চলে বৃষ্টি তাড়ানোর ছড়া- “হে বৃষ্টি ধরে যা/ লেবুর পাতায় করমচা”। অপু যাতে নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে তার কাঙ্ক্ষিত বিরাট বিশ্বের স্বাদ পেতে পারে, সেজন্য জরুরি ছিল তার সমস্ত পিছুটানের আলগা হয়ে যাওয়া। আর সেই মুক্তির সূচনা তো দুর্গার মৃত্যুতেই। যমের দুয়ারে নিজেকে পৌঁছে দিয়েই কি সেদিন ভাইয়ের জন্য দীর্ঘায়ু চেয়ে নিয়েছিল তার দিদি?
পুত্রসন্তান বংশে বাতি দেবে, এককালে বাংলার প্রচলিত বিশ্বাস ছিল এমনটাই। সেই বিশ্বাসেই গোটা পরিবারের কাছে সে একটু বেশি আদরের, বাড়তি যত্নের। সহোদরা বোনের কাছে যেন সেই আদরই এক ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। তাই নানা ব্রতে, নানা আচারে ভাইকে আগলে রাখার ইচ্ছা জারি রেখেছেন মেয়েরা। তাঁদের সেই ইচ্ছা ঠাঁই পেয়েছে বাংলার গানে-গল্পে-কথাতেও। আর সেই ইচ্ছাকে বুকে নিয়েই জেগে আছে ভাইফোঁটার মতো রীতিগুলি। যা যতখানি ধর্মীয় আচার, তার চেয়ে বেশি স্বীকৃতি দিয়েছে বাংলার মেয়েদের চিরন্তন আগলে রাখার ইচ্ছাকেই।
[ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়]