বাঘা যতীন নাকি রঘু ডাকাত? প্রকৃত কালী সাধক কে? উত্তর হল, এঁরা দুজনেই। তাহলে রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ এঁদের নাম কেন কালীর সঙ্গে জড়িয়ে? কারণটা ভক্তির। আসলে কালী সকলেরই আরাধ্যা। ভক্তের কল্পনায় তিনি স্রেফ ভিন্ন রূপে ধরা দেন। তাই ডাকাত থেকে শুরু করে বিপ্লবী, সকলেই কালীর ভক্ত। আসুন শুনে নিই।
তাঁর রূপের ছটায় জগত আলোয় ভরে ওঠে। সেই কালীকে দেখে সম্বিত হারান রামকৃষ্ণ। তাঁর লীলায় বিভোর হয়ে পথ ভুলে যান সাধক রামপ্রসাদ। আবার তাঁকে তুষ্ট করতে নরবলি দিতেও দুবার ভাবেন না রঘু ডাকাত। আরাধনার ধরণ যেমনই হোক, দেবী আসলে চান ভক্তি। আর সেই ভক্তিরসে যার হৃদয় যতটা পূর্ণ, তিনিই কালী-কে পেয়েছেন।
আরও শুনুন: বসন পরো মা… মাতৃস্বরূপা কালী কেন নগ্নিকা?
দশমহাবিদ্যার অংশ হলেও, কালীই বাংলার আদরিণি শ্যামা। তিনি যেমন রামকৃষ্ণে মা, রামপ্রসাদের মেয়ে তেমনই রঘু ডাকাতের আরাধ্যা দেবী। শুধু তাই নয়, দেবীর কাছে পার্থনা জানিয়েই সশস্ত্র অভিযানে যেতেন বিপ্লবীরা। কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে এমন হাজারও কালী মন্দির। কোনওটার সঙ্গে জড়িয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনি আবার কোনওটা ছিল কুখ্যাত ডাকাতের আস্তানা। রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদের নাম যেমন কালীর সঙ্গে জড়িয়ে, তেমনই ডাকাত বা স্বাধীনতা সংগ্রামিদের কালীপুজোও ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় বলা চলে। দুই ক্ষেত্রের কালী আরাধনার উদ্দেশ্যও খানিকটা একরকম। সেকালে ডাকাতরা মূলত জমিদার বা বড়লোকের বাড়িতে লুঠপাট চালাত। তারপর সেইসব গয়না বা টাকাপয়সা বিলিয়ে দিত গরীবদের মধ্যে। আবার স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দেবীর আরাধনা করতেন দেশকে ব্রিটিস শাসনের থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে। আবার এমনও কিছু ডাকাত ছিলেন, যাঁর উদ্দেশ্য এই দুই-ই। সেক্ষেত্রে সবথেকে বড় উদাহরণ হতে পারেন ভবানী পাঠক। তাঁর প্রতিষ্টিত মন্দিরে এখনও নিত্য পূজিতা হন দেবী কালী। এছাড়া আরও কিছু বিখ্যাত ডাকাত কালীর মন্দির রয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে।
আরও শুনুন: দেবাদিদেব হয়েও কেন মা কালীর পদতলে থাকেন শিব?
তালিকায় প্রথমেই বলতে হয়, সিঙ্গুরের পুরুষোত্তমপুরের ডাকাতকালীর কথা। কারও কারও মতে, রঘু ডাকাত এই কালীপুজোর প্রতিষ্ঠাতা। অনেকে মনে করেন, গগন ডাকাত অর্থাৎ কিনা বিশু সর্দারের হাতেই শুরু হয় এই কালীপুজোর। বাংলার এমন বহু কালীমন্দিরের সঙ্গেই জড়িয়ে গেছে ডাকাতদের নাম। হুগলির ত্রিবেণীর ডাকাতকালী মন্দির তার মধ্যে অন্যতম। শোনা যায়, রঘু, বিশের মতো ভয়ঙ্কর সব ডাকাতেররা ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে এই মন্দিরেই পুজো দিত। আউশগ্রামের পাণ্ডুক গ্রামে বামা কালীর প্রতিষ্ঠা করেন ডাকাত সর্দার প্রহ্লাদ। এখনও কার্তিক অমাবস্যায় ২২ ফুটের কালীমূর্তিতে পুজো হয় সেখানে। আবার আউশগ্রামেরই বননব গ্রামের মেটে পাড়াতে রয়েছে আরও একটি ডাকাতকালী মন্দির। এই কালীকে পাণ্ডুকের বামা কালীর বোন মনে করা হয়। এককালে হুগলির কেলেগড়ের ডাকাতকালী মন্দিরের নাম শুনলেও ভয় পেত মানুষ। তখন অবশ্য কেলেগড়ের নাম অন্য কিছু ছিল। পরে এলাকার জমিদার কালাচাঁদের নাম থেকে হয় কেলেগড়। কালাচাঁদ ছিল কালীসাধক। সকালে ধার্মিক, সূর্য ডুবলে ভয়ঙ্কর ডাকাত! শোনা যায়, লুঠপাটের পাশাপাশি অনেককে ধরে বন্দি করে রাখত কালাচাঁদ। ওই বন্দিদেরই মা কালীর সামনে বলি দিত। কলকাতার কিছু কালীমন্দিরের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে ডাকাতের নাম। তালিকায়,চেতলায় ডাকাতকালী মন্দির, কিংবা মনোহর ডাকাতের ছানাকালী বেশ বিখ্যাত।
আরও শুনুন: দেবী কালিকার নিত্যসঙ্গী শৃগাল… দেবীর ভৈরবের রূপান্তর, নাকি স্বয়ং ভৈরব?
এবার আসা যাক স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মাতৃআরাধনার কথায়। কলকাতায় যে কালীপুজোর সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি জড়িয়ে, সেখানে এখনও মহাসমারোহে কালী আরাধনা হয়। কথা বলছি, পাথুরিয়াঘাটার বিখ্যাত বড়কালী পুজোর। এই পুজোর সঙ্গে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস থেকে শুরু করে বাঘা যতীন, প্রায় সকলেরই নাম জড়িয়ে। শুধু তাই নয়, লালগোলার মহারাজা, নাটোরের মহারাজ, বাবু মন্মথ নাথ ঘোষ- সকলেই ছিলেন এই পুজোর পৃষ্ঠপোষক। একসময় সশস্ত্র বিপ্লবীদের আখড়া বসত এই পুজোকে কেন্দ্র করেই। তবে স্রেফ কলকাতার এই পুজো নয়, মেদিনীপুরেও স্বাধিনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি বিজড়িত একাধিক কালী মন্দির রয়েছে। ক্ষুদিরামও ছিলেন মাতৃসাধক। এমনটাও শোনা যায়, পুরুলিয়ার এক কালীপুজোয় বিপ্লবীদের ধরতে হামলা চালিয়েছিল ব্রিটিশরা। সেসময় পাঁচ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীকে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়েছিল স্রেফ কালীপুজো করার অপরাধে। তবে সেই পুজো এখনও বন্ধ হয়নি। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এখনও ফেরে সেদিনের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। সুতরাং একথা বলাই বাহুল্য, বাংলার কালীপুজোর ইতিহাস নেহাতই ছোট নয়। দীর্ঘ লড়াই আর ভক্তির কাহিনি জড়িয়ে আছে কালী পুজোর সঙ্গেই।