‘শ্যামা মা কি আমার কালো…’ স্রেফ গানের কথা নয়। মায়ের মূর্তির দিকে তাকিয়ে এমন প্রশ্ন তুলতে পারেন যে কেউ। কারণ, একদিকে তিনি যেমন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, লোলজিহ্বা, দিগম্বরী। অন্যদিকে তিনিই শান্তমূর্তি, স্থির, বসনপরিহিতা, নীল বর্ণের এক দেবী। তাহলে শাস্ত্রমতে দেবীর আসল রূপ কেমন? আসুন শুনে নিই।
তিনি কালের নিয়ন্ত্রণকারী। দশমহাবিদ্যার অন্যতমা। দেবীর পদতলে শায়িত মহাদেব। দু-পাশে ডাকিনি যোগিনী। চতুর্ভুজা, লোলজ্বিভা, এলোকেশী। ধ্যানমন্ত্র অনুসারে এই রূপ বর্ণনায় কোনও ভুল নেই। তবে কালী মানেই যে শুধুমাত্র এই একমাত্র রূপ তা কিন্তু নয়। দেবীর আরও একাধিক রূপের পুজোর চল রয়েছে।
আরও শুনুন: তিলক পরার ইচ্ছা জানিয়ে স্বপ্নাদেশ, স্নানযাত্রার পুণ্যলগ্নে কালীঘাটে ‘বৈষ্ণবরূপ’ জগজ্জননীর
সেক্ষেত্রে মূলত তিনটি রূপ সামনে আসে। প্রথমে, শ্যামাকালী। এই দেবীর গাত্রবর্ণ নীল। দিগম্বরী নন। কোথাও শাড়ি কোথাও ডাকের সাজ দেখা যায়। দেবী নানা অলঙ্কারে ভূষিতা। তবে বাদবাকি ক্ষেত্রে কালীর ধ্যানমন্ত্রের সঙ্গেই এর সম্পূর্ণ মিল রয়েছে। অর্থাৎ ইনিও লোলজিহ্বা। পদতলে মহাদেব। কার্ত্তিক অমাবস্যায় যে কালীপুজোর চল রয়েছে, সেখানে মূলত এই দেবী মূর্তিই দেখা যায়। কোথাও কোথাও দেবীর গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণও হতে পারে। তবে আপাতভাবে কৃষ্ণবর্ণের কালী মূর্তির আরও এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বিখ্যাত সব কালীমূর্তি, তথা ভবতারিণী, করুণাময়ী, সিদ্ধেশ্বরী, সবার ক্ষেত্রেই এই বিশেষ বৈশিষ্ট দেখা যায়। আর তা হল, দেবী মূর্তির পায়ের অবস্থান। আপাতভাবে কালীর ধ্যানমন্ত্রে পায়ের অবস্থান সম্পর্কে কিছু নির্দিষ্ট করা না থাকলেও, এই মূর্তিতে দেবীর দক্ষিণ বা ডান পা এগিয়ে থাকে। দেবী নির্দিষ্টভাবে তাঁর ডান পা সামনে এগিয়ে মহাদেবের বুকে পা রেখেছেন। বলা বাহুল্য, এর সঙ্গেই দেবীর লোলজিহ্বার সম্পর্ক টানেন অনেকেই। যেহেতু মহাদেব দেবীর স্বামী, তাই তাঁর উপর পা রাখা মাত্র দেবী জিভ কেটেছেন। তবে এ ব্যাখ্যা নিতান্তই প্রচলিত। শাস্ত্রে এর তেমন উল্লেখ নেই। সুতরাং শ্যামাকালী আর দক্ষিণাকালীর মধ্যে অমিল বলতে স্রেফ গাত্রবর্ণ এবং পায়ের অবস্থানে। বাকিটা কালীর ধ্যানমন্ত্রের সঙ্গেই মিলে যায়। কার্ত্তিক অমাবস্য্যায় দেবীর এই দুই মূর্তিরই পুজো হয়। অধিকাংশ মন্দিরে দক্ষিণাকালী, এবং মণ্ডপে মূলত শ্যামাকালী। তবে এ ছাড়াও দেবীর একটি বিশেষ রূপের পুজোর চল রয়েছে। তিনি দেবী রক্ষাকালী। দক্ষিণাকালী মূর্তির মতোই, ইনিও কৃষ্ণবর্ণা। তবে দেবী লোলজিহ্বা নন। এমনকি দেবীর হাতের সংখ্যা দুটি। সাধারণত দেবীর এই রূপের পুজো হয় বৈশাখ মাসের শেষের দিকে। গ্রামে গ্রামে দেবীর বাৎসরিক পুজোর চল রয়েছে, তবে শ্মশানকালীর প্রচলিত মূর্তিটিও ঠিক এমন। কলকাতার বিখ্যাত কেওড়াতলা মহাশ্মশানে দেবীর এই রূপেরই পুজো হয় কার্ত্তিক অমাবস্যায়। তবে দেবীর অন্যান্য মূর্তি, যেমন গুহ্যকালী, মহাকালী বা বিশেষ কিছু তন্ত্রোক্ত রূপের পুজো করার অধিকার নেই সাধারণ কারও। কেবলমাত্র তন্ত্রবিদ্য্যায় পারদর্শী কেউ দেবীর এইসব বিশেষ রূপের পুজো করতে পারেন।
আরও শুনুন: ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’ থেকে উত্থান মা কালীর! ভিনদেশির ‘বিকৃত’ ভাবনায় চটে লাল ভারতীয়রা
কালী মাত্রেই দুষ্টের দমনকারী দেবী। সুতরাং ভক্তিভরে তাঁর অর্চনা করলে যে কোনও বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারেন যে কেউ। তবে পুজোর ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু নিয়ম মানা আবশ্যক। রক্ষাকালীর পুজোর নিয়ম এবং শ্যামাকালীর পুজোর নিয়ম কিছুটা হলেও আলাদা। শ্যামাকালী পুজো মন্ডপে মন্ডপে সাধারণ কোনও পুজারি করলেও, দক্ষিণাকালী বা রক্ষাকালী পুজোর ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শী শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণ থাকা আবশ্যক। যদিও দেবীর আসল পুজো হয় ভক্তির দ্বারা। স্বয়ং রামকৃষ্ণ যে ভক্তিপুজোর প্রচলন করেছিলেন, তিনিও ছিলেন তন্ত্রোক্ত দেবী ভবতারিণীর সাধক। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে সেই দেবী মূর্তিতেই রামকৃষ্ণ খুঁজে পেয়েছিলেন ‘মা’-কে। তাই ভক্তিভরে কালীসাধনা করলে অবশ্যই ফল মিলতে বাধ্য।