কর্মক্ষেত্রে গড়ে ৭০ ঘণ্টা কাজ করার পক্ষে সম্প্রতি সওয়াল করেছেন ইনফোসিস প্রধান নারায়ণ মূর্তি। যে মন্তব্য নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক। কিন্তু তাহলে মেয়েদের ঘরে বাইরে লাগাতার কাজ করে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক হয় না কেন- এই প্রেক্ষিতে এবার পালটা প্রশ্ন তুললেন আরেক বহুজাতিক সংস্থার সিইও রাধিকা গুপ্তা। আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
৭০ ঘণ্টা কাজ করা যদি অমানবিকই হয়, তাহলে মেয়েদের সারাদিন ধরে কাজ করে যাওয়া নিয়ে কথা হয় না কেন? সেখানে তো কোনও বিতর্ক উঠতে দেখা যায়নি এতদিন। নারায়ণ মূর্তির মন্তব্যের পর যাঁরা শ্রমনীতি নিয়ে সরব হয়েছেন, তাঁদের কার্যত একহাত নিয়েই এবার নারীর শ্রমের কথাটি মনে করিয়ে দিলেন আরেক বহুজাতিক সংস্থা এডেলওয়াইজ-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং সিইও রাধিকা গুপ্তা।
আরও শুনুন: চাকরি নয়, স্বনির্ভর ব্যবসার পথেই নারীর যোগদান বাড়ছে দেশের শ্রমশক্তিতে, জানাল সমীক্ষা
সত্যি বলতে, আন্তর্জাতিক কর্মনীতিতে সাফ বলাই হয়েছে যে, কোনও কর্মীকে আট ঘণ্টার বেশি শ্রম দিতে বাধ্য করতে পারে না সংস্থা। সেখানে দেশের উন্নতির জন্য তরুণ প্রজন্মকে সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করার পরামর্শ দিয়েছেন ইনফোসিসের কর্ণধার এন আর নারায়ণ মূর্তি। যে বার্তাকে শ্রমনীতির পরিপন্থী বলেই মনে করছেন অনেকে। ভারতের মতো দেশে এমনিতেই সে নীতির ফাঁকফোকর রয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি ক্ষেত্রে। এমনকি বড় সংস্থা, বহুজাতিক সংস্থাগুলির ক্ষেত্রেও অনেক সময়েই দেখা যায় যে সেই নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গিয়েও কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন কর্মীরা। সেখানে বড় বড় সংস্থার কর্ণধারেরা যে একযোগে বেশি কাজ করার পক্ষে সওয়াল করছেন, তা দেশের সামগ্রিক কর্মসংস্থানের পক্ষে আদৌ ভালো ইঙ্গিত নয়। আর মানবিকতার দৃষ্টি থেকে দেখলে তো তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। আর ঠিক এখানেই, একটি অন্য প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন রাধিকা। সামগ্রিক কাজের পরিসরের মধ্যেও নারীর কাজের ধরন যে এখনও আলাদা রয়ে গিয়েছে, আর তা রয়েছে সমাজের মানসিকতার কারণেই, সে কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। সেই বিষয়টি নিয়েই এবার নয়া প্রশ্ন তুলেছেন রাধিকা।
আরও শুনুন: নারীর স্বাধীনতার জন্য লড়াই, মেহবুবা-মহম্মদির নোবেল স্বীকৃতিই যেন সত্যিকার দেবীপক্ষ
সত্যি বলতে, মেয়েদের গৃহশ্রমের দিকটি তো এ দেশে বরাবরই অবহেলিত। “গৃহশ্রমে মজুরি নেই বলে/ মেয়েরা কেবল বিপ্লবীর ভাত রেঁধে দেবে?”- নারীর গার্হস্থ্য শ্রম নিয়ে কবিতায় এই প্রশ্ন তুলেছিলেন কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত। আসলে গৃহশ্রমের পিছনে জীবনের অনেকখানি সময় ব্যয় করে ফেলতে হয় এদেশের অধিকাংশ মহিলাকেই। কিন্তু সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক কোনও বিচারেই যে তাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না, সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও দেশের জিডিপি কমে যাওয়ার আবহে স্টেট ব্যাঙ্ক সম্প্রতি দাবি করেছিল, মেয়েদের অবৈতনিক কাজের অর্থমূল্য যোগ করলে তার পরিমাণ দাঁড়াবে দেশের মোট জিডিপি-র সাড়ে সাত শতাংশ। অর্থাৎ মেয়েদের বিনাশ্রমে কাজের আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করলে দেশের জিডিপির হারের আংশিক উন্নতি ঘটতে পারত বলেই জানিয়েছিলেন গবেষকেরা। কিন্তু এ নাহয় গেল গৃহশ্রমের কথা। তার বাইরে যে নারীরা সরাসরি আর্থিক পারিশ্রমিক পাওয়ার মতো কাজেই যুক্ত? তাঁদের ক্ষেত্রেও কি আদৌ সেই আট ঘণ্টা কাজের হিসেব মনে রাখা হয়? অনেক কর্মরতা মহিলাই যেমন আক্ষেপ করে জানান, কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রমাণ করার জন্য অনেকসময়ই বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাঁদের, নিতে হয় বেশি দায়িত্ব পালনের ভার। কারণ, মেয়েদের কাজে নিতে অনেক কর্তৃপক্ষেরই এখনও পরোক্ষ আপত্তি কাজ করে- পাছে তাঁদের ঋতুকালীন ছুটি কিংবা মাতৃত্বকালীন ছুটি দিতে হয়। তা নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যেও যে কমবেশি তামাশা চলে, সে অভিযোগও করেন কর্মরতাদের একাংশ। এমনকি, স্বামী চাকরি করার পরেও মেয়েদের কেন কাজ করতে হবে- এ নিয়ে কটাক্ষও ভেসে আসে। সব মিলিয়ে, অনেক উচ্চপদস্থ মহিলারাও বলেন, ক্রমাগতই নিজেকে প্রমাণ করে যাওয়ার তাগিদ থাকে তাঁদের। কিন্তু কাজ তো কেবল এখানেই শেষ হয় না। এখনও অধিকাংশ বাড়িতে ঘরের কাজের দায়িত্ব অলিখিতভাবে বর্তায় মেয়েদেরই উপর। এমনকি কর্মসহায়িকা থাকলেও তাকে কাজ বুঝিয়ে দিতে হবে বাড়ির গৃহিণীকেই, তা তিনি যতই ব্যস্ত থাকুন না কেন। কাজে বেরনোর আগে বা পরে ঘর গোছানো থেকে সন্তানের দায়িত্ব পালন- এর একটা বড় অংশ, কখনও কখনও আবার সবটাই যে মেয়েদের উপরেই ন্যস্ত, সে কথা অস্বীকার করার জো নেই। যে দায়িত্বে বিচ্যুতি ঘটলে ধেয়ে আসে কাজে অবহেলার অভিযোগ। সে অভিযোগের মুখোমুখি হতে ভয় পান অনেক প্রতিষ্ঠিত নারীও। যার ফল দাঁড়ায় ঘরে আর বাইরে মেয়েদের লাগাতার কাজ করে চলা- যে কাজের মোট সময়টা আদতে কোনও কর্মনীতিরই ধার ধারে না। কর্মনীতি নিয়ে যাঁরা এখন আলাপ আলোচনা চালাচ্ছেন, মেয়েদের এহেন শ্রম নিয়ে তাঁরাও কি আদৌ সচেতন? রাধিকার কথায় উসকে উঠল সেই প্রশ্নই।