মন্দিরে পুজো পান দেবতারা। এ কথা কে না জানে বলুন? তবে শুধু দেবতা নয়, ভালো কাজ করেছেন এমন যে কারও মন্দির হতে পারে। বাস্তবে রয়েছেও তাই। রামকৃষ্ণদেব, মা সারদা কিংবা সাধু-সন্তের মন্দির রয়েছে এই দেশে। কিন্তু যাঁরা তথাকথিত মন্দ লোক! তাঁরাও কি মন্দিরে ঠাঁই পেতে পারেন? আমাদের দেশে রয়েছে তেমন মন্দিরও। মহাকাব্যে তাঁদের মন্দ কাজ করতে দেখা গেলেও, মন্দিরে পূজা পান সেইসব চরিত্ররা। আসুন শুনে নেওয়া যাক।
এতদিন যাঁদের কথা শুনলেন তাঁরা, সকলেই তো মানুষ। মন্দ হলেও তাঁদের অলৌকিক ক্ষমতা তেমন ছিল না। কর্ণ, দুর্যোধন সকলেই হয়তো মন্ত্রবলে চমৎকার ঘটাতে পারতেন। কিংবা ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে প্রলয়ও ডেকে আনতে পারতেন, কিন্তু তাঁদের কেউই অসুর ছিলেন না। তবে মহাভারতে বেশ কিছু রাক্ষস বা অসুরের উল্লেখা মেলে। বকাসুর তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ঠিক ধরেছেন, সেই বকাসুরেরও মন্দির রয়েছে এই দেশে। আজ শুন নেব সেই মন্দিরের কথাই।
আরও শুনুন: মহাকাব্যের ‘মন্দজন’, তবু আছে মন্দির! দেশের কোথায় রয়েছে শকুনির মন্দির?
দুর্গামূর্তিতে দেবীর পায়ের নীচে থাকে মহিষাসুর। দেবীর সঙ্গে পুজো করা হয় তাঁরও। এমনকি কিছু উপজাতির মধ্যে স্রেফ মহিষাসুরের পুজো করারও চল রয়েছে। সেই পুজোকে ‘হুদুড় দুর্গা’-র পুজো বলা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে মহিষাসুরের কোনও মন্দির সেইভাবে নেই। অনেকেই ভাববেন, খামোকা অসুরের মন্দির কেনই বা থাকতে যাবে? মন্দির তো দেবতার আরাধনা ক্ষেত্র। অসুরদের বিনাশ করে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হন তাঁরা। কিন্তু এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে বকাসুর মন্দির। মহাভারতের ভয়ঙ্কর সেই অসুরটিকে পুজো করা হয় এই মন্দিরে।
আরও শুনুন: মহাকাব্যের ‘মন্দজন’, তবু আছে মন্দির! দেশের কোথায় রয়েছে দুর্যোধনের মন্দির?
এই মন্দিরও দক্ষিণ ভারতের। তেলেঙ্গানার নাইনপাক নামে এক গ্রামে রয়েছে এই মন্দির। একসময় ঐ অঞ্চলের কেউই প্রায় জানত না, মন্দিরটি কোনও অসুরের। যে বিগ্রহটিকে বর্তমানে বকাসুরের রূপক হিসেবে মনে করা হয়, তা আসলে বিষ্ণুর নৃসিংহ রূপ হিসেবেই পরিচিত ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই মন্দির নিয়ে নানা গবেষনা চলেছে। সামনে এসেছে বেশ কিছু তথ্য। তার থেকেই মনে করা হয় এই মন্দির ভয়ঙ্কর বকাসুরের। কেন এখানে এই অসুরের মন্দির রয়েছে তা বলার আগে ‘বকাসুর’ কে ছিলেন সেকথা একবার মনে করে নেওয়া যাক।
আগেই বলেছি এই অসুরের উল্লেখ মেলে মহাভারতে। পান্ডবরা যখন ১৪ বছরের বনবাসে রয়েছেন, তখন বেশ কিছু ভয়ঙ্কর দৈত্য দানোর মোকাবিলা করতে হয়েছিল তাঁদের। এরপর অজ্ঞাতবাসে কাটানোর সময়ও শত্রুর অভাব ছিল না তাঁদের। এমনই এক সময় পান্ডবদের বিরুদ্ধে বকাসুর নামে এক অশুভ শক্তির উত্থান দেখা যায়। কাহিনী অনুসারে, পঞ্চপাণ্ডব মাতা কুন্তিকে নিয়ে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। কিছুদিন সেখানে কাটানোর পরই তাঁরা জানতে পারেন বকাসুরের কথা। সেই অসুর নাকি, ভয়ানক ক্ষুধার্ত। তার জন্য প্রতিদিন প্রচুর খাবার পাঠাতে হত। এমনকি একজন করে মানুষও বকাসুরের কাছে ভেট হিসেবে যেত। গ্রামের সবাই ঠিক করেছিলেন, পালা করে প্রতি পরিবার থেকে একজন করে বকাসুরের কাছে বলি হতে যাবে। এরকমই একদিন ওই ব্রাহ্মণদের পালা পড়ে। সেইকথা জানতে পারে পান্ডবরা। সব শুনে ভীম ঠিক করেন, তিনি যাবেন বকাসুরের কাছে খাবার নিয়ে। তখন আর কেউ জানেননা ভীমের শক্তি কেমন! এমনকি বকাসুরের-ও কোনও ধারণা ছিল না সে সম্পর্কে। আর এতেই হল কাল। মহাপরাক্রমশালী ভীম, বকাসুরকে হত্যা করেন সেইদিনেই। আর গ্রামবাসী চিরকালের জন্য শান্তি পান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এমন ভীষণ অসুরের মন্দির কেন তৈরি হল?
আরও শুনুন: মহাকাব্যের ‘মন্দজন’, তবু আছে মন্দির! দেশের কোথায় রয়েছে রাবণের মন্দির?
কথিত আছে, তেলেঙ্গানার ওই অঞ্চলে বকাসুর একসময় রাজা ছিল। এমনিতে সে যতই ভয়ঙ্কর হোক, তার কাজ ছিল নিজের প্রজাদের রক্ষা করা। আর সেই কাজ তিনি পালন করতেন। তাই প্রজারা তার নামে ই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে। একসময় সেখানে নিত্যপুজো হত বলেই মনে করেন অনেকে। তবে কালের গভীরে ধীরে ধীরে হারিয়েছে সেই সবকিছুই। এখন রয়ে গিয়েছে স্রেফ বিগ্রহ আর মন্দিরের স্থাপত্য। তবে এখানে কিছু দেবদেবীর মূর্তিও রয়েছে। এছাড়া এই অঞ্চল সম্পর্কে আরও এক কিংবদন্তি শোনা যায়। কয়েক দশক আগেও এখানে মাটি খুঁড়লেই নাকি সোনা পাওয়া যেত। মনে করা হয়, তা একসময় খোদ বকাসুর মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলেন।
তবে অনেকেই সেকথা বিশ্বাস করেন না। হয়তো এই মন্দির অনেকের কাছেই অজানা, তবু এখনও প্রাচীনত্বের ধারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।