একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সেই আগুনঝরা দিনে কার্টুন আঁকছেন অমল চক্রবর্তী। জেনারেল ইয়াহিয়া সেখানে ধারালো নখ আর বিরাট লেজওয়ালা অতিকায় এক ডাইনোসর, আর তার মাথায় এক মুক্তিযোদ্ধা। দানবের সঙ্গে যে লড়তে এসেছে স্রেফ একটা লাঠিকে সম্বল করেই। অমল চক্রবর্তীর এই অভিনব বয়ানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল সেই তোলপাড় সময়ের একটুকরো। যদিও এই একবার নয়। বারবার, সারাজীবন ধরেই নিজের চারপাশের সমাজে, রাজনীতিতে ঘটতে থাকা অসংগতিগুলোকে তিনি দেখেছেন আর দেখিয়েছেন। যিনি মশকরা করে বলতেন জীবনে আঁকার স্কুলের ছায়া মাড়াননি, বাঙালির আঁকাজোকায় তিনি নিজেই হয়ে উঠেছেন এক প্রতিষ্ঠান। কার্টুনের এক আলাদা ঘরানা রেখে এবার অমল আলোর দিগন্তে পাড়ি দিলেন অমল চক্রবর্তী। তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানাতে সংবাদ প্রতিদিন শোনো-তে কলম ধরলেন কার্টুনিস্ট সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়।
উপকরণ বিশেষ কিছু নয়। প্রযুক্তির ঘনঘটা নেই। অথচ কয়েক দশক ধরে বিশেষ একটি শিল্প মাধ্যমে তৈরি হল একটি অতুলনীয় সম্ভার, যা একটা জাতিকে সমৃদ্ধ করবে। কথাটা কেমন বিজ্ঞাপনের মতো শোনাচ্ছে না? ঠিক ধরেছেন। বিজ্ঞাপন। একটি বিশেষ শিল্পকীর্তি কিংবা বিশেষ শিল্পমাধ্যম মানুষের কাছে পৌঁছে যায় তখনই, যখন তার নেপথ্যে একযোগে থাকে প্রতিভা এবং পৃষ্ঠপোষকের প্রচার, অন্তত আধুনিক যুগে তো বটেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ফ্যান ক্লাব বা ডিজিটাল মিডিয়ার ঢক্কানিনাদ। কিন্তু কেউ যদি শুধু নিজের অসামান্য প্রতিভা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যান দশকের পর দশক, তাহলে কী হবে? তাহলেও হবে বইকি। অমল চক্রবর্তীর মতো অসামান্য প্রতিভার আলাদা প্রচার, এটা সেটা দরকার পড়ে না। শুধু বিষয় ভাবনা আর ছবি- এই দুটোর সম্মিলনে তৈরি হয় এমন কার্টুন, যা প্রজন্মকে ভাবিয়ে তোলে। এই ভাবনা এবং চর্চার কিন্তু মৃত্যু নেই।
অমল চক্রবর্তীর উপকরণ হল সংক্ষিপ্ত কয়েকটি রেখা এবং ছোট্ট সংলাপ। তাই দিয়ে একটা যুগ, কখনো একটা প্রজন্মের হাহাকারকে তুলে ধরা বড় সহজ নয়। তাই শিল্পীর মৃত্যুতে সে চর্চা বা ভাবনা বিঘ্নিত হয় না, হবে না কখনও। অমলদার কাজ সম্পর্কে বলা বা ব্যাখ্যা করা আমার সাধ্যাতীত। তাও বলতে গেলে বলতে হবে, অমলদার কিছু কাজ চোখের সামনে ভাসতে থাকে এবং থাকবে আমৃত্যু। কোভিড ১৯ আসার পর পরিযায়ী শ্রমিক প্রসঙ্গে তাঁর আঁকাটি। সেখানে দেখা যাচ্ছে আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে দলবদলু নেতারা আর তলা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শ্রমিকরা। একই দেশে বাস করে পরিযায়ী তকমা পাওয়া শ্রমিক আর নীতিহীন নেতাদের নিয়ে ব্যঙ্গ এবং ধিক্কার- এই পুরো বিষয়টি একই ফ্রেমে অসাধারণ ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। একটা কথা বলতেই হবে, তাঁর শিল্পের মধ্যে সমাজের বৈষম্যের দিকটা তুলে ধরার প্রয়াস ছিল ষোলো আনা আর তার সঙ্গে ছিল প্রয়োগকৌশল- অর্থাৎ লেখা ও রেখা, সব মিলিয়ে যেটা দাঁড়াত সেটা প্রাথমিকভাবে হাসির উদ্রেক করবে, তারপর ভাবাবে, বরং বলা ভালো ভাবতে বাধ্য করবে।
কিছুদিন আগে ভোটের সময় পুকুরে ব্যালট পেপারের বাক্স ফেলে দেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ ব্যালট পেপার খেয়ে ফেলেছিলেন। তা নিয়ে অমলদার একটি অনবদ্য কার্টুন দেখেছিলাম। জলের তলায় একটা মাছ আরেকটা মাছকে বলছে, মাথা নিচু করে ব্যালট খা কিন্তু জল থেকে মাথা তুলেই বুলেট খেতে হবে। রাজনৈতিক হিংসা আর নৈরাজ্যকে ব্যালট খাবার ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করে এমন ছবি যিনি আঁকতে পারেন, তিনি যদি কিংবদদন্তি না হন তাহলে কিংবদন্তি কে?
ছবি: সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়