রামদুলাল দে। হাটখোলার দত্তবাড়ির সামান্য কর্মী। নিষ্ঠা আর পরিশ্রমে তিনিই একদিন হলেন লাখপতি। মদনমোহন দত্তের জাহাজের ব্যবসায়, নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে, প্রায় লক্ষ টাকা মুনাফা করেন। অল্প সময়ে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিতও হন। পরিচিত হলেন রামদুলাল সরকার নামে। অর্থ বাড়লেই, প্রতিপত্তি পেতে চায় মানুষ। সেই কারণেই, বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করলেন রামদুলাল। কী বিশেষত্ব রয়েছে এই বাড়ির পুজোয়? আসুন শুনে নিই।
কলকাতা শহরের, হেদুয়া ছাড়িয়ে বিডন স্ট্রিট যাওয়ার পথে বাঁদিকে পড়বে লাল রঙের বাড়িটা, লাগোয়া মন্দির। বাড়ির সামনের ফলকে বড় বড় করে লেখা রামদুলাল নিবাস। ছাতুবাবু-লাটুবাবুর বাড়ী নামেও চেনেন অনেকেই। তাদের বাবা ছিলেন রামদুলাল দে। যিনি নাকি বাংলার প্রথম কোটিপতি। আজ প্রায় আড়াইশো বছর ধরে তাঁর বাড়িতে দুর্গাপুজো হয়ে আসছে। রামদুলাল নাকি, কলকাতায় বসেই আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসা চালাতেন! অথচ একটা সময় বেঁচে থাকাই কষ্টকর ছিল তাঁর।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: মা গয়না পরতেন যে বাড়িতে, বিলেত থেকে দুর্গার সাজ আনাতেন শিবকৃষ্ণ দাঁ
ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন। ঠাকুমার কাছে মানুষ। ঠাকুমারও এমন সংস্থান নেই যে নিজের পেট চালিয়েও আরেকজনের দায়িত্ব নেন। তবে দায়িত্ব যখন ঘাড়ে এসে পড়ে, আমাদের তাগিদ আরও একটু বেড়ে যায় বৈকি। রামদুলালের বৃদ্ধা ঠাকুমা তাই নাতির ও নিজের পেট চালানোর জন্য, কাজ খুঁজতে লাগলেন। হাটখোলার দত্তবাড়ি সেকালে, কলকাতার নামকরা বড়োলোক বাড়ি। বাড়ির কর্তা মদনমোহন দত্তের অনেকগুলি ব্যবসা। সে বাড়িতেই, রাঁধুনির কাজ জুটে গেল তাঁর। আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল রামদুলালও। কিন্তু ঠাকুমাই বা আর কদ্দিন। রামদুলালের নিজের তো একটা ব্যবস্থা করা দরকার। পড়াশোনা শিখেছে রামদুলাল। বেশ পরিশ্রমীও। বাড়ির মালিক বাবু মদনমোহন দত্তের নজরে পড়তে দেরি হল না। টাকার লেনদেন তাঁকে দিয়ে করিয়ে, বাজিয়েও দেখে নিলেন। বাবুর জাহাজের ব্যবসা তদারকি করার অনেকটা ভার এসে পড়ল, রামদুলালের হাতে। বাবু মদনমোহনের অন্যান্য পুরনো কর্মচারীদের বড় ঈর্ষা সেই নিয়ে। তাঁরা মদনমোহনের কান ভাঙায়। অভিযোগ করে বলে, রামদুলালের বয়স কাঁচা। এতগুলো কাঁচা টাকা সাথে থাকলে যখন তখন মতিভ্রম হতে পারে! আর তা ছাড়া, ও ছোঁড়ার পেটে পেটে কত বুদ্ধি আপনি জানেন কত্তা! ও তলে তলে সব খোঁজ রাখে। কয় তারিখে কোন জাহাজের নিলাম হবে, সেটা আগে কোথায় ছিল ? কোন জাহাজে, কত লাভ হতে পারে, কত দাম উঠতে পারে? কে কে কত দাম দিতে প্রস্তুত… সব খবর থাকে ওর কাছে! বাবু মদনমোহন হেসে বলেন, সে তো খুবই ভাল কথা। আমার ব্যবসায় কাজে লাগবে। আর মনে মনে ভাবেন, ১২ – ১৪ বছরের একটা ছেলে, গোঁফের রেখা সবে উঠতে শুরু করেছে। ওর হাত দিয়ে নিলামের টাকা পাঠালে, অনেকটা নিশ্চিন্তি। সহজে কেউ সন্দেহ করবে না। আর পাই পয়সারও হিসেব রাখে রামদুলাল। ছেলেটা বুদ্ধিমান আর সৎ।
আরও শুনুন: Durga Puja 2023: কুণ্ডুবাড়ির ঠাকুরদালানে কড়ায় বাঁধা থাকেন দেবী দুর্গা
তো এহেন মদনমোহন একদিন একটা জাহাজ নিলাম থেকে কেনার জন্য রামদুলালের হাতে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছেন। রামদুলাল তো সেই টাকার ব্যাগ হাতে নিয়ে অস্থির হয়ে এপাশ ওপাশ পায়চারি করছে জাহাজঘাটায়। বাবুর হয়ে যিনি নিলামে অংশ নেবেন সেই কর্তা তখনও এসে পৌঁছাননি। দেখতে দেখতে নিলাম শেষ। অস্থির হয়ে রামদুলাল ফিরেই আসছিলেন, টাকা নিয়ে। আজ আর কোনও জাহাজের নিলাম নেই। তাই ক্রমশ খালি হয়ে আসছিল, জাহাজঘাটা চত্বরও। এত কমে জাহাজটা হাত থেকে ফসকে যাওয়ায় আপশোশ হচ্ছিল খুবই। ক্ষীণ হয়ে আসা লোকজনের কথাবার্তা, লোহালক্কড়ের আওয়াজ, সবকিছু ছাপিয়ে হঠাৎ একটা শব্দে চমক ভাঙল রামদুলালের। একটা সাইরেনের শব্দ! যার মানে নতুন কোনও জাহাজ নিলামে চড়ছে। রামদুলাল খানিক অবাক হয়, আজ তো আর কোনও জাহাজের নিলামের কথা ছিল না! আর তাই বোধহয়, খুব একটা লোকও জড়ো হয়নি সাইরেন শুনে। কিন্তু হচ্ছে যখন একবার জাহাজখানা তার আগে তদারকি করে নেওয়া যাক। রামদুলাল এগিয়ে যায়। তেমন কেউ আসেনি দেখতে। রামদুলাল ঘুরে ঘুরে দেখে আর বোঝার চেষ্টা করে জাহাজটা বেচলে কত মুনাফা হতে পারে। নাহ, জাহাজটা নেওয়ার মত। বিক্রি করলেও ভালোই মুনাফা পাওয়া যাবে। দেখেশুনে রামদুলালাল ভাবল, বাবু যে টাকা দিয়ে পাঠিয়েছেন, তা দিয়ে এটার নিলাম ধরতে পারব। কিন্তু নিলাম ধরবেন যে কর্তা তাঁর তো পাত্তাই নেই! ওঁর জন্য যদি এই জাহাজটাও হাতছাড়া হয়ে যায়! বুদ্ধিমান রামদুলাল এবার একটু সাহস সঞ্চয় করে, দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয়, একটা জাহাজ হাত থেকে গেছে যাক, এই সুযোগটা যেতে দেওয়া যাবে না। নিলামে দর হাঁকে রামদুলাল। জিতেও যায়। দেখা যায়, সেই পুরনো, ভাঙা জাহাজ থেকে গুনে গুনে এক লক্ষ টাকা লাভ হল!
বাড়ি ফেরার পথে একটা চাপা উত্তেজনা চলছিল রামদুলালের মনে। ফিরে সে সটান বাবু মদনমোহনের কাছে গিয়ে বলল, এই নিন বাবু, আপনার টাকা। আজ ব্যবসায় অনেক লাভ হয়েছে। রামদুলাল আসার আগেই, বন্দরের খবর বাবু মদনমোহনের কানে উঠেছিল। তিনি অপেক্ষা করছিলেন, বছর ১৫-র এক কিশোরের। যার কাছে, হঠাৎ করে পেয়ে যাওয়া ১ লক্ষ টাকা। আঠারো শতাব্দীতে এটা একটা বিশাল ব্যাপার। সেই টাকার পুরোটাই, ব্যবসার মুনাফা হিসেবে তাঁর হাতে তুলে দেওয়ায়, বাবু খানিক অবাক হলেন। খুশিও হলেন রামদুলালের সততায়। বললেন, ও টাকায় আমার কোনও অধিকার নেই রামদুলাল। ও টাকা তোমার। তোমার রোজগার। তুমি এই টাকা দিয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করো। এই ভয়টাই করছিল রামদুলাল এতক্ষণ। বাবু তাকে চাকরি থেকে না তাড়িয়ে দেয়। এ তো তাই হল। রামদুলাল কেঁদে কেটে বাবুর পায়ে পড়ল। বাবু অনেক কষ্টে তাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে শেষে বললেন, তুমিই ব্যবসা করো। আমার নামে করো। মাসান্তে এসে আমায় হিসেব বুঝিয়ে দিও, কেমন?
সামান্য সরকার থেকে লক্ষপতি হয়ে গেল সেই কিশোর, রামদুলাল। আর এই প্রথম কোনও বাঙালি লাখপতি হল। খুব তাড়াতাড়ি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিতও হয়েছিলেন রামদুলাল। তারপরই দুর্গাপুজো শুরু হয় তাঁর বাড়িতে। আমেরিকা তখন সদ্য সদ্য ব্যবসার সূত্রে ভারতে আসা শুরু করেছে। এই সময় বস্টন, সালেম, ফিলাডেলফিয়া, নিউ ইয়র্ক থেকে প্রচুর জাহাজ বাংলায় আসত। নিয়ে আসত লোহা, ব্রান্ডি, নানা সামুদ্রিক মাছ, গোরুর মাংস, মোমবাতি— এ সব। আর বিনিময়ে কলকাতা থেকে তারা নিয়ে যেত চা, চিনি, নীল এবং নানা ধরনের বস্ত্র। এই কাজে আমেরিকানদের সহায়তা করতেন এ দেশীয় মুৎসুদ্দি বা ‘বেনিয়া’-রা। তাঁদের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিলেন রামদুলাল। কলকাতা শহরে তাঁর মস্ত বাড়ি হল। আর অর্থ বাড়লেই, প্রতিপত্তি পেতে চায় মানুষ। সেই কারণেই বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করলেন রামদুলাল। সময়টা ১৭৭০ থেকে ৮০ সালের মধ্যে কোনও একটা বছর।
এ বাড়ির মূর্তির বিশেষত্ব হচ্ছে, লক্ষী সরস্বতীর বদলে, দুর্গার সঙ্গে থাকেন জয়া বিজয়া। আর থাকেন কার্তিক, গণেশ। আর পাহাড়ি, সাদা ঘোটকমুখী সিংহ। শুরুতে পুজোতে বলি হলেও, একসময় বলি বন্ধ হয়ে যায়। শোনা যায় একবার নাকি বলির ছাগল, দড়ি ছিঁড়ে রামদুলালের পায়ের কাছে এসে লুকিয়ে পড়ে। দরদি রামদুলাল, সেই ছাগশিশুকে আশ্রয় দেন। সেই থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় বলি। এখন শুধু ছাঁচি কুমড়ো আর আখ বলি হয়। এও শোনা যায়, রামদুলালের দেখাদেখি সেসময় তাঁর বড় জামাই রাজা রাজকৃষ্ণ মিত্র ও পটলডাঙ্গার বসু মল্লিকদের বাড়ির পুজোতেও পশুবলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।