হয়তো একেই বলে বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য। বাংলা যখন দুর্গাপুজোয় মাতে, হিমাচলেও তখন বছরের সেরা পার্বণ। তামিলনাড়ুতেও তখন বচ্ছরকার সবচেয়ে বড় উৎসব, একই ছবি অন্ধ্রপ্রদেশে। যদিও সব জায়গাতেই যে দেবী দশভুজার আরাধনা তা নয়। তবু মহালয়া থেকে দশমী, এই দশদিন গোটা ভারত-ই মেতে ওঠে বিভিন্ন উৎসবে। কোথায় কোন উৎসব হয় জানেন? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
মহালয়া এসে গেলেই বাঙালিকে আর পায় কে! এক্কেবারে দশমী অবধি ধুন্ধুমার আনন্দের দিন। গোটা বাংলা মেতে ওঠে দুর্গাপুজোয়। কিন্তু দেশের বাকি অংশও এ সময় ফিকে থাকে না। উৎসবে মেতে ওঠে গোটা দেশ। কেবল উৎসবের ঐক্যে রয়েছে বৈচিত্রের নানা পরত। কেমন সেই বৈচিত্র?
আরও শুনুন: মহালয়ার পর টানা ৯ দিনের উদযাপন, নবরাত্রি ব্রত পালনে কী ফল মেলে জানেন?
উত্তরভারতে এইসময়টায় উদযাপিত হয় নবরাত্রি। সেও দেবী দুর্গার নয়টি বিশেষ রূপের পুজো। ৯ দিন ধরে পুজো-পাঠের সঙ্গে চলে ডান্ডিয়া খেলা, গরবা ও রাস। গুজরাত, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রেও হয় এই নবরাত্রির পুজো। রীতিমতো ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয় এই নবরাত্রি উৎসব। আবার হিমাচল প্রদেশের উৎসব কিন্তু আলাদা। এখানে হয় কুল্লু দশেরা। হিমাচল প্রদেশের কুলু উপত্যকায় উদযাপিত হয় এই কুল্লু দশেরা। নিয়ম করে প্রতি বছর রথযাত্রার দিন রঘুনাথের মূর্তি স্থাপিত হয় এখানে। আর বিজয়া দশমীর দিন হয় রাবণ বধ। এভাবেই রীতি মেনে অশুভ শক্তির নাশ করেন স্থানীয়রা। একইসঙ্গে মহীশূর ও কর্নাটকের সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব দশেরা। তবে সেখানে উদযাপনের ধরন কিছুটা আলাদা। এই সব জায়গায় এদিন হাতিকে সাজানো হয়। হাতিটিকে পরানো হয় গয়না ও বিশেষ পোশাক। এরপর সেই হাতি মহীশূরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়। সেইসময় চামুণ্ডি দেবী অধিষ্ঠান করেন ওই হাতির মাথায়। আসলে এই দেবী চামুণ্ডির মন্দির রয়েছে সেখানকার এক পাহাড়ের কোলে। নবরাত্রির ৯ দিন ধরে সেই মন্দিরেই চলে চামুণ্ডি দেবীর আরাধনা। তারপর দশেরার দিন বের হয় বর্ণাঢ্য এই শোভাযাত্রা। ভারতের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তেও এই সময়টা উৎসবেরই সময়। তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে দশেরার দিন পালিত হয় ‘বোম্মাই কলু’। যা আসলে এক ধরনের স্ত্রী আচার। ছোট ছোট পুতুল দিয়ে সাজিয়ে গ্রাম্য লোকাচার ও বিবাহের গল্প বলা হয়। থাকে দেবতার ছোট ছোট মূর্তিও। যা দেখলে বাঙালির মনে পড়বে ঝুলনের কথা। এছাড়াও নবরাত্রির এই ৯ দিন ধরে মহিলারা নিজেদের বাড়ির চারপাশ প্রদক্ষিণ করেন। ছোলা ও নারকেল দিয়ে তৈরি হয় এক ধরনের ভোগ। যা নিবেদন করা হয় পুজোয়।
আরও শুনুন: মহালয়া কি ‘অশুভ’ তিথি? এই দিন ভুলেও যেসব কাজ করবেন না
এছাড়া তামিলনাড়ু, কেরল, কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে এই সময়টাতেই হয় আয়ুধ বা অস্ত্র পুজো। নবরাত্রীর নবম দিনে এই বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। মনে করা হয়, সন্ধিপুজোর পর দেবীর আর অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। কারণ ততক্ষণে মহিষাসুর নিধন সম্পন্ন হয়েছে। তাই নবমীর দিন সেই অস্ত্রশস্ত্রের উপাসনা করা হয় আয়ুধ পুজোর মাধ্যমে। পাশাপাশি তামিলনাড়ু, কেরল ও কর্নাটকে বিজয়া দশমীর দিন পালিত হয় ‘বিদ্যারম্ভ’। এদিন সকালে পুজোর পর বই, খাতা দেবীকে নিবেদন করে পড়ুয়ারা। যাকে বলা হয় ‘এদুপ্পু’। এদিনই শিশুদের চাল বা বালির উপর দাগ কেটে প্রথমবার অক্ষর চেনানো হয়ে থাকে। যাকে বলা হয় ‘এজুথিনু এরুথু’। ব্যাপারটা অনেকটা আমাদের সরস্বতী পুজোর হাতে খড়ির মতোই। তবে শুক্লা পঞ্চমী নয়, দক্ষিণের এই রাজ্যে সেই বিদ্যারম্ভের অনুষ্ঠান হয় দুর্গাপুজোর শেষদিনে। অন্যদিকে, মহারাষ্ট্রে দশমীর দিন পালিত হয় সীমালঙ্ঘন উৎসব। এককালে মনে করা হত যে এই দিনে যুদ্ধ জয়ের জন্য কোনও দেশের সীমা লঙ্ঘন করা হলে তা রাজার জন্য শুভ হবে। আবার কেরল, কর্নাটক ও তামিলনাড়ুতে দুর্গাষ্টমীর দিনে দেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয়। এর নাম পুজোবাইপু। ব্রাহ্মণ পরিবারগুলিতে এই সময় শিক্ষা, জ্ঞান, বুদ্ধির আরাধনা করা হয়। অনেক জায়গায় নবরাত্রি ও দশেরার পুরো দশ দিন ধরেই চলে সরস্বতী বন্দনা। সুতরাং গোটা দেশজুড়েই আশ্বিন মাসের এই সময়টা উৎসবের। যার জন্য বাঙলার মতো অপেক্ষা করে থাকে গোটা দেশই।