সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে অভিনেত্রী নীনা গুপ্তার আত্মজীবনী ‘সচ কহুঁ তো’। নিজের জীবনকে খোলা পাতার মতোই মেলে ধরেছেন এই বইতে। বইটিকে যেন নিজের শর্তে বাঁচা একজন সাহসী মহিলার জবানবন্দিই বলা যায়।
শুটিং চলছে ‘খলনায়ক’ সিনেমার। নাচের জন্য গুজরাতের ঐতিহ্যবাহী পোশাক বাছা হয়েছে কস্টিউম হিসেবে। সেই সাজে ক্যামেরার সামনে অভিনেত্রী এসে দাঁড়াতেই, হঠাৎ শোনা গেল পরিচালকের কণ্ঠ। মনিটরে চোখ রেখে তিনি যেন কী একটা খুঁজছেন আর কিছুতেই খুশি হতে পারছেন না। শেষমেশ নায়িকাকে ডেকে জোরেই বললেন, একটি প্যাডেড অন্তর্বাস পরতে। যাতে লাস্যময়ী নর্তকী চরিত্রের রূপ-যৌবন ক্যামেরার সামনে বেশ খোলতাই হয়। পরিচালক তো নিজের কাজটি করলেন। কিন্তু এহেন প্রস্তাবে এমন অপমানিত হয়েছিলেন অভিনেত্রী যে, পাঁচটা বছর আর সেই পরিচালকের মুখদর্শন করেননি।
হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন খলনায়ক ছবির পরিচালক সুভাষ ঘাই সম্পর্কেই এই গল্প বলেছেন অভিনেত্রী নীনা গুপ্তা। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনী ‘সাচ কহুঁ তো’। আর সেখানেই অকপট নীনা জানিয়েছেন তাঁর জীবনের নানা অকথিত কাহিনি।
প্রায় তিনশো পাতা জুড়ে নীনা তুলে ধরেছেন তাঁর জীবনখাতার হিসেবনিকেশ। দিল্লির করোলবাগের মধ্যবিত্ত বাড়ির সাধারণ মেয়ে নীনা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃতে মাস্টার্স এবং এম ফিল ডিগ্রি পাওয়ার পর, তাঁর মাথায় চেপেছিল অভিনয়ের ভূত। একদিন গুটিগুটি পায়ে গিয়ে ভরতি হলেন ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা-য়। তারপর বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে সটান বম্বে।
বইয়ের পাঁচটি আলাদা আলাদা অধ্যায়ে যেমন রয়েছে তাঁর অভিনয়জীবনের টুকরো গল্প, পাশাপাশি আছে বাবা মা, মেয়ে মাসাবা, স্বামী বিবেক মেহরা – সবাইকে নিয়ে স্মৃতির জাল বোনা। এবং অবশ্যই আছে তাঁর জীবনের বিতর্কিত পর্ব অর্থাৎ ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের গল্পও।
একটা পার্টিতে আচমকাই নীনার দেখা হয়ে গিয়েছিল ভিভিয়ান রিচার্ডস-এর সঙ্গে। ক্যাজুয়াল আলাপ। ফোন নাম্বার পর্যন্ত আদানপ্রদান হয়নি সেবার। ভিভ বোধহয় ভুলেও গিয়েছিলেন। বছর ঘুরল। একদিন ফের এয়ারপোর্টে হঠাৎ দেখা। ভিভ তখন বিবাহিত। দুই সন্তানের জনক। স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন অ্যান্টিগুয়ায়। কিন্তু এইসব কিছুই তাঁদের প্রেমে অন্তরায় হয়নি।
ভিভের সঙ্গে সম্পর্কে থাকার সময়ই অন্তঃসত্ত্বা হন নীনা। আশির দশকে পিতৃপরিচয়হীন সন্তানকে জন্ম দেওয়া মুখের কথা ছিল না। সে সময়ে অনেকেই এগিয়ে আসেন, কেউ সাহায্য করতে, কেউ সুযোগ নিতে। নীনার বন্ধু, অভিনেতা সতীশ কৌশিক তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘ন্যান্সি, তুই আমাকে বিয়ে করে নে। মেয়ের গায়ের রং কালো হলে, আমার মেয়ে বলে চালিয়ে দিস।’ নীনা তাতে রাজি হননি। বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছিলেন সোনি রাজদানকে। পেয়েছিলেন ওম পুরিকে। অনেকেই বলেছিলেন, ওমকেই নাহয় বিয়ে করে নাও। নীনার সাফ জবাব ছিল, ওমের প্রতি তাঁর বিশেষ কোনও আকর্ষণ নেই। এমনকি, নীনার বন্ধু একজন সমকামী ব্যাঙ্কারের সঙ্গে নীনার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নারাজ ছিলেন নীনা। নিজের জীবনটা বাঁচতে চেয়েছিলেন নিজের শর্তেই।
নীনার বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর, তাঁকে আর তাঁর ভাই পঙ্কজকে যত্নে বড় করে তুলেছিলেন তাঁদের মা। মাকে দেখেই হয়তো নীনা নিজেকে ‘সিঙ্গল মাদার’ হিসেবে দেখার সাহস পেয়েছিলেন।
নিজের অভিনেত্রী জীবনের গোড়ার দিকের কথা বলতে গিয়ে নীনা জানিয়েছেন, একসময় তাঁকে ডাকা হত ‘লাল্লু লেড়কি’ বলে। ন্যাশানাল স্কুল অফ ড্রামা-র ছাত্রী হলেও কমার্শিয়াল ফিল্মের পরিচালকরা তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যেই ফেলতেন না।
যদিও শ্যাম বেনেগালের নির্দেশনায় ‘মান্ডি’, ‘ত্রিকাল’, ‘সুস্মান’, ‘সুরজ কা সাতয়া ঘোড়া’, টেলিভিশনের জন্য ‘যাত্রা’-য় অভিনয় করেন। ‘ত্রিকাল’ ছবিতে অভিনয়ের সূত্রেই নীনার প্রথম বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন সত্যি হয়। গিয়েছিলেন ব্রাজিলের একটি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে। সবাই যখন শহর ঘুরছেন, কেনাকাটা করছেন, নীনার হাত তখন ফাঁকা। ব্যাপারটা নজর এড়ায়নি শ্যাম বেনেগালের। নীনাকে আড়ালে ডেকে তিনি বলেছিলেন, ‘হোটেলে যাও, এই নাও আমার ঘরের চাবি। কেনাকাটা করতে যা টাকা লাগে ড্রয়ার থেকে নিয়ে এসো।’ শ্যাম সাহেবের কথা উঠলেই, নীনা তাই কৃতজ্ঞতা এবং শ্রদ্ধায় মনে মনে নতজানু হন।
অনেকেই জানেন না, ‘সাঁস’ সিরিয়ালে নীনা শুধু মূল চরিত্রে অভিনয়ই করেননি। তিনি-ই ছিলেন এই সিরিয়ালের কাহিনিকার ও পরিচালক। ‘সাঁস’ পরিচালনার জন্য তিনি পুরস্কৃতও হয়েছিলেন।
নিজের প্রেমের আরও কিছু কিসসা এই বইতে জানিয়েছেন নীনা। যেমন, বিনোদ খান্নার জন্য তিনি ছিলেন পাগল। তাঁর সঙ্গে নীনার প্রথম অভিনয় ‘বাটওয়ারা’ ছবিতে। নিজের হার্টথ্রবকে সামনে পেয়ে নীনা তখন দিশেহারা। কিন্তু ‘ভদ্রলোক’ বিনোদ শালীনতার সীমা ছাড়াননি।
নীনার প্রথম বিয়ে এক বাঙালির সঙ্গে। তাঁর নাম অম্লানকুসুম ঘোষ। অভিনেতা অলোকনাথ, পণ্ডিত যশরাজের ছেলে সারঙ্গদেব পণ্ডিত, কার সঙ্গে না নীনার নাম জড়িয়েছে! সারঙ্গদেবের সঙ্গে তাঁর নাকি এনগেজমেন্ট অবধি হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেই এনগেজমেন্ট ভেঙে যায়।
নিজের সম্পর্ক, প্রেম মাতৃত্ব থেকে বলিউডে কাস্টিং কাউচের খপ্পরে পড়া – কোনও কিছুই আড়াল করেননি নীনা। আসলে আজীবন তিনি চলেছেন নিজের শর্তে। উনপঞ্চাশে এসে ফের বিয়ে করেছেন পেশায় চ্যার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট বিবেক মেহরাকে। আত্মজীবনীতেও নীনা একইরকম বোল্ড। বইয়ের কথামুখে নীনা জানান, ‘বই লেখা মানে নিজের জীবনের গভীরতর, অন্ধকার রহস্যগুলোকে সবার সামনে মেলে ধরা। জীবনে যা ভুলচুক করেছি সেসব কথা সাদা পাতায় লিখে চলা। আসলে আমি টুকরো টুকরো হয়েছি বারবার, ভেঙে চুরমার হয়েছি। কিন্তু আজও যাঁরা একই সমস্যায় ভুগেছেন বা ভুগে চলেছেন, এই গল্প হয়তো তাঁদের খানিক সাহস বা শক্তি জোগাবে।’
বিশেষত মেয়েদের তিনি বলতে চান– ‘ক্ষতি, ক্ষত, ভাঙা সম্পর্কের সারি আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা পেরিয়ে, আবার উঠে দাঁড়িয়েছি, সবচেয়ে বড় কথা, ভাল থেকেছি। আমি পারলে, আপনারাও পারবেন! এই আশা! এই সাহস! এইটুকুই দিতে চেয়েছি।’
ঠিক এখানেই স্বতন্ত্র নীনার আত্মজীবনী। তা কেবল তাঁর আত্মকথন হয়েই থেকে থাকতে চায় না। বরং অনেকের মুখে ভাষা জোগানোর অঙ্গীকারও নেয়।
—————–
সচ কহুঁ তো
নীনা গুপ্ত
প্রকাশক – Penguin Ebury Press
দাম – ৫৯৯ টাকা