যে মেয়েদের কণ্ঠরোধের জন্য এত তোড়জোড়, এবার তাদেরই স্বীকৃতি মিলল বিশ্বমঞ্চে। নারীস্বাধীনতার পক্ষে লড়াইয়ের জেরে ইরানের নার্গিস মহম্মদি, আফগানিস্তানের মেহবুবা সিরাজের নাম বিবেচনা করতে হল খোদ নোবেল কমিটিকে। মেয়েদের মুখ ঢেকে দেওয়ার লাগাতার চেষ্টাকে এই যে একরকমভাবে হার মানতে হল মেয়েদের লড়াইয়ের সামনে, এখানেই যেন সত্যিকার দেবীপক্ষের সূচনা হল। লিখছেন, রণিতা চট্টোপাধ্যায়।
রাজার ঠিক করে দেওয়া বিধির বিপক্ষে গিয়ে কথা বলেছিল এক মেয়ে। পরিণামে মরতে হয়েছিল তাকে। রবীন্দ্রনাথ যে গল্প লিখেছিলেন তাঁর ‘নটীর পূজা’ নাটকে, সেই কাহিনির এক আধুনিক বয়ানে একালের নাট্যকার কৌশিক সেন আবার আরেক শাস্তির বিধান দিয়েছিলেন। সেখানে মেয়েটিকে মেরে ফেলা হয় না, কেবল এক গণ্ডির মধ্যে তার প্রতিবাদকে ফেলে রাখে শাসক- যাতে একসময় গণ্ডির বাইরের বৃহত্তর সমাজ তার কথা ভুলে যায়। ইরম শর্মিলা চানুর দীর্ঘ অনশন এবং তার প্রেক্ষিতে শাসকের নীরবতাকে কটাক্ষ করেই এই বয়ান নির্মাণ করেছিলেন তিনি। আসলে, এ সবই তো মেয়েদের কণ্ঠরোধের একেকটি হাতিয়ার। কোথাও মার, কোথাও অপমান, কোথাও শাস্তি, এমনই নানা উপায়ে মেয়েদের নিজের স্বর রুখে দিতে চাওয়া হয়েছে বারে বারে। যেমনটা চেয়েছে ইরান কিংবা আফগানিস্তান। কিন্তু সেই ইরানেই এবার নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন জেলবন্দি সমাজকর্মী নার্গিস মহম্মদি। আর নোবেলের দৌড়েই তাঁর সঙ্গে ছিলেন মেহবুবা সিরাজ-ও। তিনি আফগানিস্তানের সমাজকর্মী। মেয়েদের কথা বলার সপক্ষে, মেয়েদের নিজের মতো বাঁচার সপক্ষে দুজনেই কথা বলে চলেছেন লাগাতার। পালটা সে কথাকে পিষে মারার লাগাতার চেষ্টাও চলছে, যেমন চলে। কিন্তু সেই চেষ্টাকে হার মানিয়ে যে শেষমেশ বিশ্বমঞ্চেও পৌঁছে গেল এই দুই নারীর লড়াইয়ের কথা, এও কি এক বড় জয় নয়? যে দুটি দেশেই ক্রমাগত মেয়েদের মুখ ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, মেয়েদের মানুষ হিসেবে ভাবতেই যারা নারাজ, সেখানেই সমস্ত অবদমন ছাপিয়ে যে মেয়েদের লড়াইয়ের কথা জেগে রইল- এখানেই যেন সূচনা হল সত্যিকার দেবীপক্ষের।
আরও শুনুন: ‘পুত্র’রা শুধু নন, প্রীতিলতা বুঝিয়েছিলেন দেশ-মায়ের জন্য প্রাণ দিতে পারেন ‘কন্যা’রাও
ইরান কিংবা আফগানিস্তান, দুই দেশই মেয়েদের পায়ে বেড়ি পরিয়ে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। বোরখা ছাড়া রাস্তায় বেরোনো যাবে না, পাছে শরীরের উঁচুনিচু দেখে ফেলে কোনও পুরুষ হোঁচট খায়। চুল খুলে রাখা যাবে না, ঢেকে রাখতে হবে হিজাবের কড়া শাসনে। ২০২২ সালেই ঠিকমতো হিজাব পরেননি বলে ২২ বছরের মাহসা আমিনিকে গ্রেপ্তার করেছিল ইরানের নীতিপুলিশেরা, আর তারপর পুলিশি হেফাজতেই মৃত্যু হয় তাঁর। মাহসার মৃত্যুতে ইরানের পথে নামেন হাজার হাজার মেয়ে। হাজার হাজার মানুষ। রাষ্ট্র অবাক হয়ে দেখে, মেয়েরা নাচতে নাচতে হিজাব খুলে ফেলছেন। ছুড়ে দিচ্ছেন আগুনে। শখের কোমরসমান চুল কাঁচি দিয়ে কেটে দিচ্ছেন মরিয়ম ফারাহমান্দ, পতাকা বেঁধে দিচ্ছেন তাঁর প্রেমিক আহমদ তোরাবি। চুল উড়ছে পতাকা হয়ে, যে চুলের সূর্য-দেখা বারণ। ‘মেয়েদের যা করা উচিত’-সুলভ কোনও তত্ত্বের ছায়ায় নয়, সেদিন মেয়েরা নিজেরাই লিখতে শুরু করেছিলেন নিজেদের প্রতিবাদের বর্ণমালা। যেমনটা আগেও লেখা হয়েছে ইরানে। ফুটবল খেলা দেখতে গিয়েছিলেন বলে যে সাহার খোদায়েরি-কে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তিনি মামলার রায় বেরোবার দিনটিতেই আদালত চত্বরেই গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন। সেদিন সাহার খোদায়েরির পুড়তে থাকা শরীর থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে গিয়েছিল সারা ইরানে। অবশেষে, একটি মেয়ের প্রাণের দামে ইরানের সব স্টেডিয়ামের দরজা খুলে গিয়েছিল মেয়েদের জন্য। আবার শামসিয়া হাসানি-র কথাই ধরা যাক না! আফগানভূমে তালিবানের হানায় যা ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা ঢেকে দিতেই রং তুলি নিয়ে পথে নেমেছেন কাবুলের তরুণী অধ্যাপিকা। কখনও তাঁর দিকে ছোড়া হয় পাথর, কখনও ছুটে আসে অকথা কুকথা। এমনকি তালিবানি উগ্রপন্থীদের ছোড়া অ্যাসিডেও আহত হয়েছিলেন এই তরুণী। তবুও কাবুলের ক্ষতবিক্ষত দেওয়ালগুলোয় তিনি উজ্জ্বল রঙে এঁকে চলেছেন যুদ্ধ ও যুদ্ধের পরের সময়কে। তালিবান শাসনে বিধ্বস্ত মেয়েদের হয়ে কথা বলছে সেসব ছবি।
আসলে শাসকের মার যেমন চিরদিনের সত্য, মারের মুখের উপর প্রতিরোধ গড়াও তেমনই চিরন্তন। মেয়েদের উপর যত অবদমন নেমে এসেছে, তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সেই কাজটাই করে চলেছেন অনেক মেয়ে। ৫১ বছরের নার্গিস মহম্মদি ১৩ বার গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর জন্য মোট ৩১ বছরের জেল আর ১৫৪ ঘা চাবুকের বেশি আর কিছু বরাদ্দ করতে পারেনি ইরান সরকার। সেই ঘেরাটোপে বসেও টেলিফোনের মাধ্যমে, গোপনে একাধিক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নার্গিস, বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁর লড়াইয়ের আওয়াজ। আর সেই জেলের ঘেরাটোপেই এবার তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছে নোবেলের খবর। চলতি বছরের নোবেলের মনোনয়নে ৭৪ বছরের মেহবুবা সিরাজের কথাও ভাবতে হয়েছিল কমিটিকে, কেন-না তালিবানের চাপানো হিজাবে ঢাকা আফগান অন্দরমহল থেকে মেহবুবা বলছেন- “We are the hope, we are the power keeping Afghanistan together.”
আরও শুনুন: আর এক মালালা! তালিবান হানায় ভাঙা দেওয়ালে ছবি আঁকেন কাবুলের অ্যাসিড আক্রান্ত তরুণী
হ্যাঁ, মেহবুবা মহম্মদিরাই আশা দেখান। আশা দেখান, সমস্ত দমন পীড়নের সামনে জেগে থাকবে প্রতিবাদ। রক্তের অক্ষরে লেখা হবে প্রতিরোধের বয়ান। আর যখনই শাসকের চাবুক নেমে আসে নার্গিস মহম্মদির পিঠে আর সেই চাবুকের পালটা ভেসে আসে নোবেল মঞ্চের করতালি, ঠিক তখনই বোধহয়, মর্তে নেমে আসে সত্যিকার দেবীপক্ষ।