একই মূর্তিতে বাহন হিসেবে রয়েছে বাঘ এবং সিংহ। অথচ দেবী দশভুজা। মূর্তিতে রয়েছে সবুজ রঙের এক অসুরও। আকারে ভঙ্গীতে, সেই মূর্তি হবহু দেবী দুর্গার। কিন্তু দুর্গা মূর্তিতে বাঘ থাকবে কেন? নিশ্চয়ই ভাবছেন, হালের কোনও থিম শিল্পী এমন মূর্তি তৈরি করেছেন। একেবারেই নয়। এই মূর্তিই বাংলার আদি দুর্গার। কোথায় রয়েছেন তাঁর মন্দির? আসুন শুনে নিই।
তখনকার কলকাতার সঙ্গে আজকের কোনও তুলনা চলে না। বেশ কিছু অঞ্চলে তখনও ঘন জঙ্গল। তার মধ্যে ডাকাতের আস্তানা। রাত গভীর হলেই কোনও বড়লোক জমিদার বাড়িতে হানা দিত সেই দস্যুর দল। সাধারণত এঁরা হতেন কালীভক্ত। কিন্তু কলকাতার এক ডাকাতের আরাধ্যা ছিলেন দেবী দুর্গা। সেই ডাকাতের নামেই দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন এখনও।
আরও শুনুন: ২৪০ বছরের দুর্গাপুজোর আলো হঠাৎ নিভেছিল বিশ্বনাথ মোতিলাল বাড়িতে
কথা বলছি, দেবী চিত্তেশ্বরীর সম্পর্কে। এককালে কলকাতার ত্রাস ছিল, চিতে ডাকাত। সেই ভয়ানক দস্যুর আরাধ্যা ছিলেন এই দেবী। আর চিতে ডাকাতের নাম থেকেই এই দেবী চিত্তেশ্বরী হিসেবে পরিচিতা। বর্তমানে কলকাতার কাশীপুর অঞ্চলে দেখা মিলবে এই দেবীর মন্দির। তবে সেকালে এমন মন্দির ছিল না। একেবারে জঙ্গলে ভরা এলাকায় ছোট্ট কুটিরের মধ্যে দেবীর আরাধনা করতেন কুখ্যাত চিতে ডাকাত। মূর্তিটি নিম কাঠের তৈরি। বেশ কিছু বইয়ে এই মূর্তিকে কালীমূর্তি বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই দেবীর মূর্তি কোনওভাবেই কালীর সঙ্গে মেলে না। গাত্রবর্ণ হলুদ। দেবী দশভুজা। দুর্গার মতোই এঁরও দশ হাতে দশ অস্ত্র। নীচের দিকে এক হাতে দেবী একটি সাপ ধরে রয়েছেন। যা দেবীর পায়ের নীচে থাকা অসুরের দিকে ফণা তুলেছে। অসুরের রং সবুজ। সেই হিসেবে একে মহিষাসুরের সঙ্গেও তুলনা করা যেতে পারে। দেবীর আরেক পা রয়েছে সিংহের উপর। সেইও অবশ্য ঘোটকমুখী। তবে মূর্তির আসল চমক আসুরের পায়ের দিকে তাকালে চোখে পড়ে। তার এক পায়ে যেমন দেবী দাঁড়িয়ে রয়েছে, অন্য পায়ের সামনে রয়েছে এক বাঘ। ডোরাকাটা দাগের সেই বাঘ আকারে ছোট হলেও, তার চেহারা বেশ হিংস্র বলেই মনে হতে পারে। কারণ এই বাঘ আসলে সুন্দরবনের ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’-এর প্রতীক। কিংবা এঁকে বাঘ্র্যদেবতাও বলা চলে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দুর্গা মূর্তিতে হঠাৎ বাঘ এল কেন?
সে কথা জানতে গেলে ফিরে যেতে হবে মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সময়ে। মন্দিরের গায়ে লেখা ফলক অনুযায়ী এই মন্দির ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্টিত হয়েছিল। কিন্তু কথিত আছে তারও আগে দেবীর আরাধনা শুরু করেছিলেন চিতে ডাকাত। সে সময় ভাগীরথীর তীরে অবস্থিত কাশীপুর সংলগ্ন এই অঞ্চলটি ছিল জলাজঙ্গলে ভরা। গুটি কয়েক জেলেমাঝির বাস ছিল এই চত্বরে। ডাকাতের আস্তানা গড়ার ক্ষেত্রে একেবারে আদর্শ জায়গা। কিন্তু স্রেফ ডাকাত নয়, এই অঞ্চলে ছিল ছিল বাঘের উৎপাতও। তাই এই অঞ্চলের মানুষ বাঘের পুজো করতেন। যেমনটা সুন্দরবনের লোকজন এখনও করে থাকেন। মনে করা হয়, চিতে ডাকাত দেবী মূর্তি তৈরির সময় সেই বাঘ দেবতার মূর্তিটিই বানিয়েছিলেন ওইভাবে। তিনি নিজেও সেই দেবতার পুজো করতেন। শোনা যায় ডাকাতি করতে যাওয়ার আগে তন্ত্রমতে এই মূর্তির পুজো করতেন তিনি। সেই রীতি মেনে এখনও দেবীর পুজো শুরু করার আগে বাঘ্র দেবতার পুজো করা হয়। এবার আসা যাক চিত্তেশ্বরী দেবীর সঙ্গে প্রচলিত কিছু কিংবদন্তির কথায়।
আরও শুনুন: দে মল্লিক বাড়িতে এখনও পূজিতা হন রাজা হর্ষবর্ধনের কুলদেবী
শোনা যায়, একসময় এই মন্দিরে নিয়মিত নরবলি হত। ইংরেজ কোম্পানির লেখা বিবরণেও সে উল্লেখ মেল। তবে চিতে ডাকাত মারা যাওয়ার পর সেই প্রথা বন্ধ হয়। এইসময় দীর্ঘদিন অবহেলায় পড়েছিলেন দেবী চিত্তেশ্বরী। তারপর দেবীর স্বপ্নাদেশ পান এক ব্রহ্মচারী। তিনিই নতুন করে দেবীর পুজো শুরু করেন। তখনও দেবীর মন্দির তৈরি হয়নি। কিন্তু এইসময় দেবীর কৃপায় বেশ কিছু অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন করেন ওই ব্রহ্মচারী। কিছুদিনের মধ্যেই সে কথা ছড়িয়ে পড়ে। মন্দিরে ভিড় জমাতে শুরু করেন ভক্তরা। এমনই এক ভক্ত জমিদার দেবীর মন্দির গড়ে দেন। পরে অবশ্য বহুবার সংস্কার হয়েছে মন্দিরের। শোনা যায়, এই মন্দিরে যাতায়াত ছিল ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের। এলাকার মানুষের কাছেও দেবী চিত্তেশ্বরী দুর্গা হিসেবেই পরিচিতা। আর মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় দেখে এঁকেই বাংলার আদি দুর্গা হিসেবে মনে করে থাকেন অনেকেই।