ন্যায়বিচার চেয়ে পুলিশের লাঠির সামনে পড়তে হয়েছিল যাঁদের, সেই অ্যাথলিটদের হাত ধরেই এশিয়াডে ১০০ পদকের মাইলস্টোন ছুঁল দেশ। যে আকাশছোঁয়া জয় আরও একবার শীর্ষে পৌঁছে দিল ভারতকে। কিন্তু এই আনন্দের আবহে এই প্রশ্নও জেগে থাকুক, ১০০ পদকের দেশে যোগ্য সম্মানটুকু পেতে খেলোয়াড়দের আর ধরনায় বসতে হবে না তো?
নিজেদের ব্যক্তিগত লড়াইগুলো পিছনে ফেলে রেখে দেশের জন্য লড়াই করতে চেয়েছিলেন সেই মেয়েরা। কিন্তু তাদের সেই অধিকার দিতেও দ্বিধায় পড়েছিল প্রশাসন। খেলার দুনিয়ার সেই অধিকার আদায়ের গল্প বলেছিল ‘চক দে ইন্ডিয়া’। কিন্তু বাস্তবটা তো আর ছবির মতো হয় না। তাই বাস্তবের মাটিতে দেখা যায়, ধরনায় বসে আছেন দেশের তাবড় ক্রীড়াবিদরা। কিছুদিন আগেই যাঁরা দেশের পতাকাকে তুলে ধরেছিলেন বিশ্বের মঞ্চে, দেশকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বিশ্বের শীর্ষে, নিজেদের দাবিটুকু শোনানোর জন্য সেদিন পথে নেমে আসা ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না তাঁদের কাছে। কীসের দাবি? না, খেলোয়াড়ি সুযোগসুবিধার দাবিদাওয়া অব্দিও যাননি তাঁরা। স্রেফ সম্মান চেয়েছিলেন। দাবি করেছিলেন যৌন হেনস্তার প্রতিকার। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, স্রেফ ন্যায়বিচারের দাবিতেই দিনের পর দিন ধরনায় বসতে হল এ দেশের ক্রীড়াবিদদের। অবশেষে, যেদিন নতুন ভারতে সোনার ‘ন্যায়দণ্ড’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সেই দিন খোদ সংসদ ভবনের সামনে, পুলিশি হেনস্তার মুখোমুখি হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে হল তাঁদের। যে ছবি আসলে দেশের সম্মানকেই মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল সেদিন। কিন্তু এবার, ফের দেশকে গৌরবের তুঙ্গে পৌঁছে দিলেন খেলোয়াড়রাই। এশিয়ান গেমসে সর্বকালের সব রেকর্ড ভেঙে ১০০-র বেশি পদক এল ভারতের ঘরে। এমনকি পদকজয়ী দেশগুলির মধ্যে প্রথম পাঁচেও ঠাঁই করে নিল ভারত। এই বেনজির কৃতিত্বের পর স্বাভাবিকভাবেই ক্রীড়াজগৎ থেকে সরকার, সব মহলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় ভেসে গিয়েছেন অ্যাথলিটরা। কিন্তু সেই আনন্দের আবহেও মুছে যাচ্ছে না দেশের পতাকা হাতে বিনেশ-সাক্ষীদের মাটিতে পড়ে থাকার স্মৃতি। তাই এখনও এই প্রশ্ন জিইয়ে রাখা দরকার, এই কৃতিত্ব কি এবার যোগ্য সম্মানটুকু দেবে তাঁদের? স্রেফ সম্মানের দাবিতে, ১০০ পদকের দেশে খেলোয়াড়দের আর ধরনায় বসতে হবে না তো?
আরও শুনুন: এ কোন ‘অমৃতকাল’! সাক্ষী-ভিনেশরা মাটিতে পড়ে, মাটিতে মিশল দেশের সম্মানও
এমনিতে এ দেশে ক্রিকেট ঘিরে যে বিপুল উন্মাদনা দেখা যায়, প্রশাসন-বিজ্ঞাপন-মিডিয়ার যে পরিমাণ প্রসাদ বর্ষিত হয় তার উপরে, সেখানে অন্যান্য খেলাগুলি প্রায় দুয়োরানি হয়েই থাকে। তারপরেও কিন্তু কবাডি থেকে কুস্তি, তিরন্দাজি থেকে টেবিল টেনিস, ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের রুখে দেওয়া ক্রমশ দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমনকি এই মুহূর্তে যে দেশের মাটিতেই বিশ্বকাপ আয়োজন করা গিয়েছে, সেই উত্তেজনাও অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে এশিয়াডের দুরন্ত সাফল্যে। বিশ্বকাপের ম্যাচেও মাঠ ভরছে না দর্শকে। এদিকে খেলার খবরের পাতায় রোহিত-বিরাটদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাগ বসাচ্ছেন নীরজ, জ্যোতি, আন্নু রানি-রা। সত্যি বলতে এবার এশিয়ান গেমস শুরুর অনেক আগে থেকেই স্লোগান উঠেছিল, ‘ইস্ বার ১০০ পার’। অর্থাৎ এবার ১০০ পদকের গণ্ডি পেরিয়ে যাবে ভারত। মন্ত্রীসান্ত্রি, রাজনীতিবিদ, বলিউড তারকা- কে ছিলেন না সেই প্রচারে! তাঁদের হতাশ করেননি অ্যাথলিটেরা। আগের মোট পদকের থেকে ৩০টিরও বেশি পদক জিতে এশিয়াডে ‘সেঞ্চুরি’ করে ফেলেছেন তাঁরা। কিন্তু এ কথাও তো ভোলার নয় যে, তাঁদের বঞ্চনার দিনে, ন্যায়বিচারের দাবিতে তাঁদের আন্দোলনের দিনে, এই ঝলমলে মুখেরা কেউই প্রায় একটি কথাও বলেননি। আজ খেলোয়াড়দের যে সাফল্যের আলো গায়ে মেখে নিচ্ছে গোটা দেশ, তাঁদের অসম্মানের দিনে সেই বেদনার শরিক হওয়ার কথাও কি ছিল না? বা তার চেয়েও বড় কথা, সেই অসম্মান কি কোনোভাবেই প্রাপ্য ছিল দেশের পতাকাবাহী এই সৈনিকদের?
আরও শুনুন: জার্সির ভাঁজে যত্নে রাখা হারানো জীবন, বদলে গেলেও তাকে ফেলে দেওয়া যায় না
রাজনীতির খেলা আর খেলার রাজনীতির মাঝে পড়ে অনেকসময়ই বিপর্যস্ত হয়েছেন ভারতের খেলোয়াড়রা। তার পরেও, দেশের পতাকাকে উঁচুতে তুলে রাখার লক্ষ্যে তাঁরা দৌড়ে গিয়েছেন, দৌড়ে যাবেনও। তাঁদের ভূলুণ্ঠিত হওয়ার দিনেও আমরা জানতাম, শত লাঞ্ছনা সত্ত্বেও ওঁরা লড়বেন। ওঁরা লড়েছেন। অনেক আগুন পেরিয়ে ভারতমাতার মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন জয়ের মুকুট। কিন্তু সেই বিজয়ী ভারত এবার তাঁদের প্রাপ্য সম্মান ফেরাবে তো? সে প্রশ্নটুকু আমাদেরই জিইয়ে রাখা জরুরি।