অসুরদের অত্যাচারে যখন দেবতাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলেন তাঁরা। তখন দেবতাদের মিলিত তেজপুঞ্জ থেকে জন্ম নিলেন দেবী দুর্গা। অসুর নিধনের জন্যই তাঁর আবির্ভাব। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর সেই অসুরবধের বিস্তারিত বর্ণনা মেলে। স্রেফ মহিষাসুর নন, দেবীস্তোত্রে ব্যখ্যা মেলে আরও কয়েকজন ভয়ঙ্কর অসুর বিনাশের কাহিনি। যার অন্যতম মধু-কৈটভ বধ। তবে দেবী মহামায়া একা নন, সেখানে ভূমিকা ছিল স্বয়ং বিষ্ণুরও। আসুন শুনে নিই সেই আখ্যান।
বাতাসে ভাসছে পুজোর গন্ধ। আর মাত্র দিনকয়েকের অপেক্ষা। মহালয়ের ভোর থেকেই পাড়ায় পাড়ায় বাজবে পুজোর গান। কোথাও ভেসে আসবে, ‘ইয়া চণ্ডী মধুকৈটভাদিদৈত্যদলনী’; আবার অন্য কোথাও শোনা যাবে, ‘আশ্বিন মাসে বাপের বাড়ি আসেন ভগবতী’। আসলে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব যাঁকে কেন্দ্র করে, তিনি একদিকে যেমন ঘরের মেয়ে অন্যদিকে তেমনই দৈত্যদলনী রণচণ্ডী।
আরও শুনুন:
দেবীর আগমন-গমনই বলে দেয় বছরের ভাগ্য, এবার কীসে চড়ে মর্তে আসছেন মা দুর্গা?
একবার নয়। যখনই দেবতাগণ কোনও বিপদে পড়েছেন তাঁদের ত্রাতা হয়ে সামনে এসেছেন দেবী মহামায়া। কখনও প্রত্যক্ষভাবে, কখনও বা ত্রিদেবের মাধ্যমে। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে সেই দেবী মাহাত্ম্যের উল্লেখ মেলে। যেমন অর্গলাস্তোত্রে উল্লেখ রয়েছে,
মধুকৈটভবিধ্বংসি বিধাতৃবরদে নমঃ।
রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি।।
অর্থাৎ হে দেবী, তুমি মধুকৈটভ নামক দুই অসুরকে বিনাশ করেছিলে। তুমি ব্রহ্মাকে বরপ্রদানকারী। তোমায় প্রণাম করি। তুমি আমায় রূপ অর্থাৎ পরমাত্মবস্তু, জয় অর্থাৎ বেদশাস্ত্রের জ্ঞান এবং যশ অর্থাৎ শাস্ত্রজ্ঞের খ্যাতি প্রদান করো। তুমি আমার কাম-ক্রোধ নাশ করো। দেবীস্তোস্ত্রের এই অংশ থেকেই অনেকে মনে করেন, মধু-কৈটভকে বধ করেছিলেন দেবী মহামায়াই। তবে মধু-কৈটভ বধে দেবী মহামায়ার সক্রিয় ভূমিকা থাকলেও, দুই ভয়ঙ্কর অসুরের বিনাশকারী হিসেবে উল্লেখ মেলে শ্রীবিষ্ণুরও।
আরও শুনুন:
৯ দিন ধরে দেবী দুর্গার ৯ রূপের আরাধনা, নবরাত্রি ব্রতের রয়েছে বিশেষ ফল
কী সেই কাহিনি?
প্রলয়কালে পৃথিবী এক বিরাট কারণ-সমুদ্রে পরিণত হলে, শ্রীবিষ্ণু সেই সমুদ্রের উপর অনন্তনাগকে শয্যা করে যোগনিদ্রায় মগ্ন হন। এই সময় বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই দৈত্য নির্গত হয়। প্রথমে তাঁদের স্বরূপ প্রকাশ হয়নি। তবে, কিছুদিনের মধ্যেই স্বমূর্তি ধারণ করে দুই অসুর। তাদের মনে হাজারও জিজ্ঞাসা। এ জগৎ কার তৈরি? কেন তারা এখানে রয়েছে, ইত্যাদি বহু প্রশ্ন ছিল তাদের। আর সেই প্রশ্ন করার জন্য তাদের সামনে ছিলেন পদ্মযোনি ব্রহ্মা। দুজনেই বিভিন্নভাবে ব্রহ্মাদেবকে উত্যক্ত করতে আরম্ভ করে। একসময় তারা বিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত ব্রহ্মাকে বধ করতেও উদ্যত হয়। ভীত ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করার অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনও উপায় না পেয়ে তিনি যোগনিদ্রার স্তব করতে শুরু করেন। আসলে এই স্তব দেবী মহামায়াকে তুষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে আরম্ভ করেছিলেন ব্রহ্মা। একসময় ব্রহ্মার স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী তাঁর সামনে প্রকট হন। দেবীকে নিজের সমস্যার কথা খুলে বলেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা। তাঁর প্রার্থনা ছিল, দেবী যেন শ্রীবিষ্ণুকে জাগ্রত করেন। সেইমতো দেবী মহামায় জাগরিত করলেন শ্রীবিষ্ণুকে। যোগনিদ্রা ত্যাগ করেই শ্রীবিষ্ণু মধু-কৈটভ বধে উদ্যত হলেন। প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে চলে সেই মহাসংগ্রাম। তবে তাতেও মধু-কৈটভ বধ সম্পন্ন হয় না। অতঃপর এই দেবীই বিষ্ণুর দৈত্যবধের সহায়ক হলেন। দেবী দুর্গা, মতান্তরে যোগনিদ্রা বা যোগমায়া দুই দৈত্যকেই মোহাচ্ছন্ন করলেন। তবে বধের পূর্বে দুই দৈত্যই প্রার্থনা করল, বিষ্ণুর হাতেই তারা মৃত্যুবরণ করতে চায়। সেইমতো বিষ্ণুর নির্দেশে সুদর্শন চক্র শিরোশ্ছেদ করল দুই ভয়ঙ্কর দৈত্যের। তবে এই কাজ দেবী মহামায়াকে ছাড়া অসম্ভব ছিল। দেবীর সাহায্যেই মধু-কৈটভকে বধ করতে সক্ষম হন বিষ্ণু। তাই দেবীকে বলা হয় মধু-কৈটভ বিনাশিনী। দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনার শুরুতেই তাই স্মরণ করা হয় তাঁর এই কীর্তির। আর কটাদিন পরেই দেবীপক্ষের শুরু। মধুকৈটভদলনী দেবী মহামায়র আরাধনাতেই তাই রত হবে মর্তবাসী।