আম্বেদকরের তৈরি যে সংবিধানকে অনুসরণ করে আজকের ভারত, সেই সংবিধানের বাইরেও ছিল আরও এক সংবিধান। যার খসড়া তৈরি করেছিল সাভারকরের হিন্দু মহাসভা। কেমন ছিল সেই সংবিধান? আসুন, শুনে নেওয়া যাক।
নতুন সংসদ ভবনের যাত্রা শুরুর আবহেই সম্প্রতি দেখা গিয়েছে দেশের সংবিধানের এক নতুন রূপ। যে সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে উধাও ‘সেকুলার’ ও ‘সোশালিস্ট’ শব্দ দুটি। অর্থাৎ সংবিধানের প্রস্তাবনায় দেশের যে ধর্মনিরপেক্ষ ছবিটিকে দীর্ঘদিন ধরে তুলে ধরা হয়েছে, তা অনেকখানিই পালটে গিয়েছে এই নয়া সংবিধানের বক্তব্যে। আর গেরুয়া শিবিরের বক্তব্যে যেহেতু অনেকসময়ই হিন্দুরাষ্ট্রের দাবি প্রকট হয়ে উঠেছে, সেই প্রেক্ষিতেই প্রশ্ন উঠেছে এই বদল নিয়ে। আসলে এই প্রথম নয়, এর আগেও তো বাবাসাহেব আম্বেদকরকে নিয়ে বিদ্রুপ শোনা গিয়েছে একাধিক হিন্দুত্ববাদী নেতার মুখে। আসলে দলিতদের গুরুত্ব দিয়ে, সাম্যের ভাবনাকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে যে সংবিধানের খসড়া করেছিলেন আম্বেদকর, হিন্দুরাষ্ট্রের পক্ষে সওয়াল করা নেতারা সে ভাবনাকে মেনে নিতে বরাবরই অস্বস্তিতে পড়েছেন। আর তাঁদের সেই ধারণার উৎস আসলে লুকিয়ে রয়েছে আরও অনেক বছর আগে, যখন হিন্দুরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার সপক্ষে যুক্তি সাজিয়েছিলেন সাভারকর। এই নেতাকে মান্যতা দেওয়া আরএসএস শিবির বা হিন্দুত্ববাদীরা যে হিন্দুরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে থাকবেন, তাতে সত্যিই আশ্চর্যের কিছু নেই। কিন্তু অবাক হওয়ার কথা এখানেই, যে, স্বাধীন দেশের সম্ভাব্য সংবিধান হিসেবে একটি সংবিধান বানিয়েছিল সাভারকরের হিন্দু মহাসভা। ঠিক সংবিধান নয় অবশ্য, সংবিধানের খসড়া ছিল তা। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেখানে হিন্দুরাষ্ট্রের দাবিটি প্রাধান্য পায়নি।
আরও শুনুন: ইসলাম ধর্মাবলম্বী সাংসদকে ধর্ম তুলে কটূক্তি, বিতর্কে জড়িয়েছেন আগেও… কে এই রমেশ বিধুরি?
হ্যাঁ, ১৯৪৪ সালে কনস্টিটিউশন অফ দ্য হিন্দুস্তান ফ্রি স্টেট, এই শিরোনামে একটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করেছিল সর্বভারতীয় হিন্দু মহাসভা। ইন্ডিয়া কিংবা ভারত, কোনও নামটিই দেশের জন্য বাছা হয়নি, বেছে নেওয়া হয়েছিল হিন্দুস্তান। বিনায়ক দামোদর সাভারকরের নেতৃত্বে পরিচালিত এই দল যে সাভারকরের ভাবনা ধরেই হাঁটবে, এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল। যে ভাবনা বলে, সিন্ধু ও সিন্ধু সাগরের মধ্যবর্তী ভূমিকে যারা নিজেদের পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি বলে স্বীকৃতি দেয়, তারা সকলেই হিন্দু। এই পরিসরের মধ্যে শিখ, জৈন, বৌদ্ধদের জায়গা হলেও মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের যে জায়গা নেই, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু সংবিধানের খসড়া তৈরির সময় এই কট্টর ভাবনাকে সরিয়ে রেখেছিল সাভারকরের দল। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রেরই মর্যাদা পেয়েছিল দেশ, তার কোনও জাতীয় ধর্ম রাখা হয়নি। ডিভি গোখেল, লক্ষ্মণ ভোপাটকর, কে ভি কেলকর এবং এম আর ধর্মাধেরে, এই চারজন মিলে লিখেছিলেন সেই সংবিধানের খসড়াটি, আর তার মুখবন্ধ লেখেন এন সি কেলকর। কার্যত এটিই কোনও হিন্দুত্ববাদী দলের তৈরি করা প্রথম সংবিধান। আসলে ১৯৩৯ সালে কলকাতায় মহাসভার অধিবেশনে সাভারকর যে বক্তব্য রেখেছিলেন, যেখানে তিনি ভবিষ্যতের ভারতের রূপরেখা এঁকে দেন, তা ধরেই এই সংবিধান তৈরি হয়ে উঠেছিল।
আরও শুনুন: মহিলা বিল থেকে নয়া সংসদ ভবন, সরকারি প্রচারের ‘মুখ’ দেশের অভিনেত্রীরাই!
যে হিন্দুরাষ্ট্রের দাবিকে সাভারকর তথা হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ হিসেবেই তুলে ধরা হয়, কিছুদিন আগে সে কথাকে খানিক খণ্ডন করেছিলেন রাজস্থানের এক কংগ্রেস নেতা। তিনি বলেছিলেন, তখনও আমাদের সংবিধান তৈরি হয়নি, দেশের ভাবনাও সংগঠিত রূপ পায়নি। সেই সময়ে সাভারকর হিন্দুরাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। এবার দেখা গেল, সংবিধান বানানোর ক্ষেত্রে সেই ভাবনা থেকে সরেই এসেছিলেন সাভারকর।