দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, রোদ্দুর মিত্র-র গল্প রঙ্গিলা। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে। তাঁদের বিচারে যুগ্ম তৃতীয় স্থান পেয়েছে এই গল্পটি।
পাঠ-অভিনয় শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
১.
আধমরা একটা শিরীষগাছের টঙে বসেছিল দাঁড়কাক। গাছের নীচে টাইমকল। জল আসেনি। সামনে দেওয়াল। শামুক হাঁটছে না। শামুকের চেয়ে শান্ত হাতে। ভজা লিখছিল। ‘আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে উন্নয়নকে আরও এগি—’
— কী হল? থেমে গেলি যে!
রামধনুর পাজামা। দাঁড়কাকের মতো শরীর। চোখের সমস্ত নক্ষত্র খসে গেছে। ভজা! ভজার বুকের ভেতরে যেন ভাঙা মসজিদ একটা। আজান হয় না কতদিন! গতকাল সেখানে খুশি এসেছিল। ভোররাতে। ভজার দিকে তাকায়নি। তাকিয়েছিল আঁকার খাতায়। বলল— গায়ে আমার দুধে-আলতা রং দিলেন কেন? হেবি রোম্যান্টিক কোনও বেহালা বাজল। ব্যাকগ্রাউন্ডে। তখনই উলটে গেল একটা ভাতের হাঁড়ি। শব্দ হল খুব। হামলে পড়ল কালো বেড়াল। মাথার ওপরে দাঁড়কাকের চিৎকার।
— আরে থেমে গেলি কেন তুই!
— সুবলদা আমার আঁকার স্কুলটা?
— হবে বলেছি তো!
— পুকুরের ওই পাড়ে? বটগাছের নীচে?
— হ্যাঁ।
— ভজার ভূত আছে ওখানে!
— শিগগির দেওয়ালটা ফিনিশ কর। তারপর বাড়ি যা।
টাইমকলে জলের ফোয়ারা। দাঁড়কাক নেমে এল। কলতলায় বসে স্নান করল। ধ্যানীর মতো। মেরিলিন মনরোর মতো ডানা ঝাপটাল তারপর। অনেকক্ষণ। ভজার চোখ ভিজে গেল। ডানার জলে।
২.
ভজা ফুরিয়ে যাচ্ছে। হাত কাঁপে। ভাগাড় হয়ে যায় মন। ছবি আঁকার সময়। তার শামুকজন্মের খোলস। ভেঙে যায়। বারবার। পেট মুচড়ে খিদে পায়। ভাতের হাঁড়ি উলটে পড়ে আছে। ফাঁকা। অন্ধকার। আস্ত একটা ব্ল্যাকহোল। ভজাকে টেনে নেয় যখন, সে দেখতে পায় কাঁঠালপাকা গরমে, এক ডাবওয়ালা, দুপুরের সঙ্গে কী অমোঘ দোস্তি, ডাব লাগবে, ডাআআআআব…যতক্ষণ আলো থাকবে, সে ততক্ষণ অনলাইন, নামের পাশে সবুজ আলো জ্বলবে, কচি ডাবের মতো, এমন সময়ে কেউ যেন ডাবওয়ালাকে নিয়োগ করেছে, বিনিময়ে পেয়েছে একবাগান নারকেল গাছ—
নারকেল গাছ দিয়ে কিছু হয় না। ছবিটাও শেষ হয় না তাই। এখন টাকা লাগে। পাওয়ার লাগে। সুবলদা যেমন বলে। গলার শিরা ফুলিয়ে। আগুন ঝরে। আশরীর। হাঁড়ির ভেতর থেকে ভজা বেরিয়ে আসে।
আকাশে মেঘ। এক বিদ্যুৎ থেকে দুই বিদ্যুতের ঝিলিক। ঝড় আরও ঘন হয়। ভজা তখনও বাইরে। এ জীবনে রঙের প্যালেট কুড়িয়েছে যত! কলপাড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। লাল—নীল—কালো—সবুজ—খয়েরি—গেরুয়া— গুলিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ঝড়ের নেশা লেগেছে ওদের।
ভজার ঘরে শিরীষগাছের পাতা উড়ছে। মরা। শুকনো। পাতা। জানলা খুলে দিল হাঁ। উথালপাথাল ছেঁড়া পর্দা। সেলাইবিধ্বস্ত বিছানার চাদর। মড়ার মতো পড়ে আছে পুরনো সিঁদুরকৌটো। আয়নায় রিফ্লেকশান: কেউ নির্ঘাত খুন হয়েছে। ভজা ছড়িয়ে বসল মেঝেতে। ছড়িয়ে দিল আঁকার খাতা। তারপর। ক্ষ্যাপার মতো রং দিল খাতায়। রং মাখল হাতে-পায়ে-বুকে-পিঠে। কালো রং মেখে নিল মুখে। ঠিক সুবলদার মতো দেখাচ্ছে না? পাওয়ার চাই, পাওয়ার!
ভজার টালির চালে সেই যে লাউগাছ উঠেছিল, লাউগাছের আকর্ষ ছুঁয়ে, সকালের কাঁচা রোদ পড়েছিল খুশির মুখে, তখন সব কাজ ফেলে, ভজা, ছবি আঁকবে ভেবেছিল, রোদের ওই অনন্ত গতিপথ ধরে দৌড়বে, দৌড়তে দৌড়তে জন্ম নেবে ছায়া, সে ছায়া আসলে কোনও শিল্পীর, ভ্যান গখের হয়তো, নক্ষত্রদেশ থেকে গমখেত পর্যন্ত বিস্তার, মধ্যে যেন একা একটা লাউগাছ, একমাত্র সত্য, আঁকড়ে ধরতে চাইছে পৃথিবীর পা—
ধুত্তোর! ভজা আদপে কেউ না। সে বাচ্চাদের আঁকা শেখায়। দেওয়াল লেখে। কুকুরের মতো বেঁচে থাকে। সুবলদা প্রতিমাসে পাঁচশো টাকা দেয়। বছরে দু’বার নতুন টালি। আর একটা সাধ। প্রতিমুহূর্তে খুঁচিয়ে দেয়। আঁকার স্কুল! আঁকার স্কুল! এরপর ভজা দেওয়াল লিখিয়ে হয়ে যাবে। দেওয়ালের ইট খাবে। সে ভুলে যাবে শামুকজন্ম। খোলসে টোকা পড়ে। বাইরে ঝড়। প্রবল।
৩.
— বাড়ি আছিস ভজা?
— কী রে? ঘাপটি মারলি?
— এক থেকে দশ গুনব। না বেরোলে ক্যাজরা হয়ে যাবে।
— আমাদের দেওয়ালে রং লাগিয়েছিস তুই?
কেমন মেঘ ডাকে! অ্যাপোক্যালিপ্স যেন সামনে। কেঁপে ওঠে ভজা। চিৎকার করে। সুবলদা বলেছিল। তাই লিখেছি। কেউ শুনতে পায় না।
— তোর সুবলদাও খুব উড়ছে কদিন।
— এক…দুই…তিন
— সুবলদার চোদ্দ গুষ্টিও তোকে পোঁচে না রে হারামি!
— শুয়োরের বাচ্চা! রং আজকে গুঁজে দেব আচ্ছেসে!
— তারপর সুবলদার পার্টিকে গুঁজব!
— বেরোবি না তো?
ভজা জানত। এমন হবে। আর আজকেই হবে। সুবলদার ফোন সুইচড অফ। কোথায় গেল সুবলদার ছেলেরা! ভজা একা। ভজার সামনে চোদ্দখানা বাইক। পিস্তল। হকি স্টিক। মৃত্যু। খুশির জন্য কান্না পাচ্ছে। অনেকদিন পরে। খুশির ঝুলকালি গা। সেই গায়ে দুধে-আলতা রং! খুব মনে পড়ছে। সেদিন রাগের মাথায়, পেটে যে কেন লাথি মেরেছিল! নিশ্চিত আজ বেঁচে যেত ভজা। ঝড় ঠেকিয়ে দিতে পারত। ইঁদুরমারা বিষের শিশিটা কোথায়! ভজা খুঁজে পেল না।
— লাস্টবারের মতো বলছি ভজা, বেরিয়ে আয়।
— আট…নয়…
— খুব ভুল করছিস ভজা! আজ কিন্তু বাওয়াল হয়ে যাবে।
— দশ!
টালির চালে দুমদাম ইঁট। শিলাবৃষ্টি হচ্ছে? টিনের দরজায় লাথি। শিউরে উঠল পাড়া। দুয়ার এঁটে। ভজার বড় আদরের শিউলিগাছ। উপড়ে গেল। কাঠের জানলার পাল্লা ভেঙে নিল কেউ। এক লাথিতে! আরও ইট। আরও খিস্তি। আরও ভেঙে গেল। ভজা!
বৃষ্টিছাঁট তীব্র হয়েছে যে সময় থেকে, ভূতের মতো, জোকারের মতো, হাতে রঙের কৌটো আর একগাদা তুলি নিয়ে ভজা বাইরে বেরিয়েছিল, তখনই অতিলৌকিক কোনও মন্ত্রবলে পা টলে যায়, মন টলে যায়, হাত টলে যায়, ভজার গায়ে কেউ হাত দিতে পারে না, আটটা ছেলে ভজার সামনে, সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে দেখছে ভজার মুখ, কালো মুখ, চোখ রেখেছে যেন দুরবিনে, আর দূরে একটা ম্যাকাও পাখি বসে আছে, সেই ফাঁকে, ভজা তাদের শরীরে ছিটিয়ে দিল লাল-নীল-হলুদ-সবুজ রঙ, চোখের নীচে তুলি ধরলেই বেরিয়ে আসছে পাওয়ার, প্লাস্টিকের জিভগুলো, যারা এতদিন সাইলেন্ট মোডে ছিল, কথা বলতে চাইছিল রঙিন রঙিন, আর একটানে রবারের মেরুদণ্ড ছিঁড়ে, শূন্যস্থানে পুঁতে দিল বুনোফুলের চারা…
ভজা আজকে ছবি আঁকবে। ভালো মানুষের। কারা বলে ভজা ফুরিয়ে গেছে! ভজাদের ফুরিয়ে যেতে নেই। ভজা পাগলাকুত্তা। বাগে আনা অতই সহজ সুবলদা?
বৃষ্টিতে। একটা ছায়া। পথে নামল। সে ছায়া স্বাধীন। দাঁড়কাকের মতো। পচামাংসের টুকরো ফেলে দিয়েছে। ছায়া যখন অবয়ব পেল। বৃষ্টি থেমেছে। পুকুরের ওই পাড়ে। বটগাছের নীচে। একটা আঁকার খাতা। মনে হয় পৃথিবীর ছাদ। আলো পড়লে দেখা যাবে খুশির মুখ। দেখা যাবে ঘরভর্তি সূর্যমুখী ফুল। পাহাড়। নদী। ফুল। তারাভরা আকাশ। একটা আঁকার স্কুল। ভূত আছে ওখানে! ভজার ভূত! কী আশ্চর্য রঙিন!
অনেক রাতে ভজার রক্তাক্ত শরীরটাকে তুলে ধরার জন্যে কেউ আসে না। মিশকালো বিড়াল গত তিনদিনের বাসি ভাতের হাঁড়ির মধ্যে গড়াগড়ি খেয়েছিল মহানন্দে।
~০~
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: