দে’জ পাবলিশিং নিবেদিত, সংবাদ প্রতিদিন শোনো আয়োজিত ‘গল্পের সেরা হাত’ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত গল্পগুলি থেকে শুনে নিন, ডি. অমিতাভ-র গল্প মাছ চুরি। এই প্রতিযোগিতার তিন বিচারক ছিলেন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক অমর মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী ও জয়ন্ত দে। তাঁদের বিচারে যুগ্ম তৃতীয় স্থান পেয়েছে এই গল্পটি।
পাঠ চৈতালী বক্সী, শঙ্খ বিশ্বাস
শব্দগ্রহণ অঙ্কুর নন্দী
অলংকরণ সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
বেঁটেখাটো হলে কী হবে, জয়ন্তর শরীর কাঠামো শক্তপোক্ত। খালি গায়ে নিজের আড়াই গুণ লম্বা ছিপ খালে নাচায় যখন তার দুহাতের বাইসেপের সঙ্গে ভি-কাটিং বডিতে ফুটে ওঠে পেটের মই-মাসল ও বুক-মাসল। গরমে লুঙ্গির গিঁট ভিজে যায়, কিন্তু জয়ন্তর ছিপ নাচানো থামে না। তার শরীরে শক্তির অভাব নেই। কিন্তু অলাভজনকভাবে শক্তিক্ষয় করতে একটা প্রগাঢ় নেশা লাগে। জয়ন্তর শক্তির অপচয়ের মাধ্যম এই মাছের নেশা।
না হলে তার শক্তি দেখানো এবং সেখান থেকে পয়সা রোজগারের জায়গার অভাব ছিল না। জয়ন্তর বজবজ চটকলে পার্মানেন্ট স্পিনারের চাকরি আছে। পাট থেকে দড়ি তৈরির সময় স্পিনিং মেশিনে দ্রুত দড়ির জোগান রাখতে হয়। এ কাজে দক্ষতার সঙ্গে নাগাড়ে কাজ করে যেতে শক্তির প্রয়োজন। সব লেবার স্পিনারের কাজ পায় না। জয়ন্ত শক্তি আর দক্ষতার জোরে জেনারেল হেল্পার থেকে স্পিনিং টেকনিশিয়ান বা চটকলের চালু কথায় স্পিনারের কাজ পেয়েছিল। এ কাজে রোজ বেশি। লোভও বেশি। ডবল ডিউটির লোভ। কিন্তু জয়ন্ত সেসব লোভকে তুড়ি মেরে ই.এস.আই ডাক্তারের থেকে অসুস্থতা লিখিয়ে এনে মাছ ধরে।
মাছের নেশা প্রবল নেশা। পৃথিবীতে সবথেকে বড়োলোক নেশার মধ্যে মাছধরার নেশা সনাতন। বড়োলোকের নেশা গরিব লোকে ধরলে তার মধ্যে বিষ মিশে যায়। জয়ন্তর মাছ ধরার আনন্দে নেশা ধরায় মাছ চুরির খেলা।
মাছ ধরতে বুদ্ধি লাগে। তার থেকেও বেশি বুদ্ধি লাগে মাছ চুরি করতে। ঠিক বুদ্ধি না, কুবুদ্ধি। জয়ন্ত কারও পুকুর ছেঁচা হলে বলতে গেলে বিনেপয়সায় খেটে দেয়। দমকল বসানো থেকে ঝাঁকায় মাছ ধুয়ে মাছের কাঁটায় মাছ বিক্রি করে দেওয়া পর্যন্ত। না, জয়ন্তর টাকাপয়সা চুরিতে মন নেই। মাছ বিক্রির টাকা ঠিকঠাক মালিকের হাতে পৌঁছে দেয়। এ ব্যাপারে তার সুনাম আছে।
তাহলে জয়ন্ত চুরি করে কী? কীভাবে করে? ছেঁচা পুকুর মানে তো সাফা মাঠ। তাহলে! সেখানেই জয়ন্তর কেরামতি। পুকুরের উপর দিকে যেখানে পাঁক অপেক্ষাকৃত শক্ত সেখানে পায়ের চাপে খাঁজ করে দামি মাছ লুকিয়ে রাখে। শাল, বোয়াল বা বড়ো কই। পুকুরের সেরা মাছ মালিকের চোখে ধুলো দিয়ে চুরি করাই জয়ন্তর বড়াই করার মতো কাজ।
তারপর আছে মহাজাল টানার সময় মাছ চুরি। জাল টানতে টানতে পায়ের চাপে মাছ ধরে মাঝপুকুরে জালের সামনে ছুড়ে দেয় সে। মালিক খুশি। জেলেরাও জয়ন্তর দক্ষতায় বিস্মিত। কিন্তু তারই মাঝে জয়ন্তর ট্যাঁকে কখন যে বেশ কিছু বাটা বা শিঙিমাছ ঢুকে যায়, কেউ বুঝতেই পারে না।
জাল টেনে বা ছেঁচা পুকুরে মাছ চুরি তো কম আলোর ভোরে। মাছ চুরির আসল রোমাঞ্চ তো দিনে দুপুরে ছিপ দিয়ে অন্যের পুকুরে মাছ তোলা। মাছের সঙ্গে টোপ দিয়ে বুদ্ধির কসরত আর মালিকের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। দিনে ছিপে মাছ চুরি করতে নানান কৌশল নিতে হয়। ছিপের সাইজ হাত দেড়েকের বেশি হলে চলবে না। মাছের চার হতে হবে মারাত্মক কার্যকরী। পাউরুটিতে জ্বালানি মদে পচা খোলের সঙ্গে বোলতার টিপ মিশিয়ে বানাতে হয় সে টোপ।
গ্রামের বাড়িঘরদোর ছাড়িয়ে যেসব পুকুর সেখানেই ছিপের ওস্তাদি। গাছের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ফাতনায় চোখ রাখতে হয়। ছোটো ছিপ হওয়ার কারণে খিঁচতে অসুবিধা। জোরে খিঁচলে নড়াচড়ায় লোকের চোখে পড়ার ভয়। আজকাল ছেলেপিলের যা বাড়বাড়ন্ত, বড়ো টোপ দিতেও ভয় লাগে জয়ন্তর। টপ্ করে টোপ পড়লে এই না কেউ শুনতে পায়। তার মধ্যেই জয়ন্ত ধৈর্য আর দক্ষতার জোরে কেরামতি দেখায় মাছ চুরির।
২
এসব অনেক আগের কথা। বিশ-বাইশ বছর তো হবেই। তখন নিম্মলা মাছে ভাতে ছিল জয়ন্তর সংসারে। দুবেলায় চারবার মাছ খেয়েছে এমনও দিন গেছে তার। তবে গ্রামের পাশে বুড়ো অজগরের মতো মজা খালটা ছাড়া তাদের জলকর শূন্য। তাই তারা কখনও মাছ খাওয়া নিয়ে বড়াই করেনি।
মাছ মারা নাকি বড়াই করার কিছু নয়ও। অনেকদিন আগে রামপো জেলের সঙ্গে নিম্মলার কিছুটা আশনাই হয়েছিল। রামপো জেলে ছিল জয়ন্ত মোড়লের ইয়ার দোস্ত। দুজনের সম্পর্ক-স্বার্থ গড়ে উঠেছিল মাছে। রামপোর জয়ন্তর থেকে জানার ছিল মাছের টোপ। কিন্তু কেমন করে যেন টোপে গেঁথে যায় নিম্মলা।
“জানো তো বউদি, মাচের অভিশাপ বড়ো অভিশাপ!”
নিম্মলা নতুন মানুষের কাছে নতুন কথা শুনে হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিল। তাদের দাবার দোলায় বসে জয়ন্তর মতো দুলতে দুলতে বলেছিল রামপো জেলে।
“মাচেরা যেদিন অভিশাপ দেয় মানুষ ধ্বংস হয়ে যাবে!”
“কেন ঠাকুরপো?”
“কত মাচ ওজ মারি বলো দিকিনি বউদি? একটা মাচের পেরানের জন্ন্যি ঝদি একটা মানুষ মরে তালে পৃথিবীতে মানুষ আর থাকবে?”
সত্যিই তো। এমন করে নিম্মলা ভাবেনি কখনও। চুরির মাছে তার বেশ কিছুদিন মন উঠে গিয়েছিল। রামপো টোপের কারিকুরি শিখে আর জয়ন্তর বাড়িমুখো হয়নি। তা না আসুক ক্ষতি নেই। নারীর মনে প্রেমের থেকে সংসারের শেকড় অনেক বেশি।
রামপোর কথা অনুযায়ী নিম্মলা এখন ভাবে, মাছেদের অভিশাপেই জয়ন্তর শরীরে পক্ষাঘাত আর তার দু-দুটো ছেলে থাকতেও বুড়ো বয়েসে লোকের বাড়ি ঝি-খেটে মরতে হচ্ছে।
জ্যৈষ্ঠের সকাল। বাসিপাটের পরেই হালদারগিন্নি ফরমাশ করল, “নিম্মলাবউ, ঘাটপুকুর থেকেন চাড্ডি মাছ ধরে দে’দিকি! সানের পাশেই হাতছিপ পড়ে আছে। রান্নাঘর থেকে আটা মেখে নে।”
কদিন থেকেই নিম্মলা সুযোগটা খুঁজছিল। ঘাটে বাসন মাজতে এলেই তেলাপিয়ার গায়ে হাত লেগে যাচ্ছে অথচ ঘরে মানুষটা একটু আঁশের জন্যে ছটপট করছে!
নিম্মলা জয়ন্তর পক্ষাঘাতের পর থেকেই হালদারদের বাড়িতে সকালের কাজ করছে। দু-ছেলে বাবা-মাকে ভাত দেয়নি। বিয়ের পর থেকেই অভাবে অনটনে চলছিল নিম্মলার সংসার। অথচ তার বাবা চটকলের চাকরি দেখেই তার বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কাজে না গিয়ে মাছের নেশায় পড়লে দুবেলা মাছ জোটে, ভাত জোটে না। তবুও চলছিল, কিন্তু জয়ন্তর পক্ষাঘাত গড়িয়ে চলাটাও থামিয়ে দেয়।
নিম্মলা হালদারগিন্নি ঘাটে আসার আগেই পটপট হাতছিপে অনেকগুলো তেলাপিয়া ধরে ফেলে। তার মধ্যে তিনটে বড়ো দেখে মাছের মুড়ো হোঁতলে শাড়ির ভাঁজে লুকিয়ে ফেলে। মানুষটা বিছানায় শুয়ে মাছ মাছ করছে। রামপোর শেখানো পাপপুণ্য, অভিশাপের কথা ভুলে অসুস্থ মানুষটার চাহিদার কথা ভাবে। বেঁচে থাকতে গেলে অনেক পাপ-তাপ করতে হয়। অভাবের থেকে পাপ কী আছে! সুস্থ অবস্থায় মানুষটা অনেক নামী-দামি, সুস্বাদু মাছ খাইয়েছে। আর সে অসুস্থ, প্রায় মরণাপন্ন স্বামীর জন্য সামান্য তেলাপিয়া দু-চারটে খাওয়াতে পারবে না!
হালদারগিন্নি গ্যাঁট হয়ে বসেছে সানের চাতালে। দূর থেকেই দেখছে নিম্মলার মাছ লুকোনো।
নিম্মলা মাছ ধরতেই থাকে। তেলাপিয়া সাদা আটার টোপও খায় খুব। হালদারগিন্নি আপত্তি করে না, তাদের বাড়ির সদস্য অনেক। তার আপত্তি মাছ চুরির। সে আজ হাতেনাতে ধরতে চায় নিম্মলাকে। গ্রামের সেরা মাছ চোর জয়ন্তকে ধরতে না পারলেও তার বউকে ধরতে পারার মধ্যে বাহাদুরি আছে বইকি!
নিম্মলা অপেক্ষা করে হালদারগিন্নির সরে যাওয়ার। কিন্তু সকালের সব কাজ ফেলে হালদারগিন্নি আজ বড়ো-কাজে হাত দিয়েছে। সময়ের টানাপড়েন চলতেই থাকে। কিন্তু হালদারগিন্নির হাতে অফুরান সময় থাকলেও নিম্মলার হাতে সময় বাঁধা। এখান থেকে চক্রবর্তীদের বাড়িতে কাজে যাওয়ার মাঝে মানুষটাকে তুলে মুখ-হাত-পা ধোয়াতে হবে।
ছিপ সরিয়ে নিম্মলা আলুথালু উঠে পড়ে। বেশি দেরি করলে বিছানায় হেগে মুতে ফেলবে অসুস্থ মানুষটা। নিম্মলার শাড়ি থেকে জ্যৈষ্ঠের পাকা আম খসে পড়ার মতো মাছগুলো ঝরে পড়ে।
গল্পের সেরা হাত প্রতিযোগিতার ফলাফল: