দেশের শ্রমিকসংখ্যার মধ্যে ক্রমশ বাড়ছে মহিলাদের যোগদান। সম্প্রতি এমনটাই দাবি করল এক সমীক্ষা। তবে কি আর্থিক কাজে মেয়েদের কম অংশগ্রহণের যে ছবি এতদিন চেনা ছিল, তা পালটাল? নাকি এর নেপথ্যে রয়েছে অন্য কোনও কারণ? শুনে নেওয়া যাক।
ঘরের কাজ যেন বরাবরই মেয়েদের জন্য বরাদ্দ। যদিও সেই গার্হস্থ্য শ্রমে কোনও মজুরি মেলে না, তাকে কাজ বলে গণ্যই করেন না অনেকে। কিন্তু সেখানে বাইরের অর্থকরী কাজে মেয়েরা যোগ দেবে কি না, তা নিয়েও বিতর্কের শেষ নেই। আবার অনেক মহিলাও কোনও পেশায় যোগ দেওয়ার বদলে অন্দরমহলের জীবন বেছে নিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। সব মিলিয়ে, এ দেশের মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার হার যতখানি বেড়েছে, কর্মরতা মহিলাদের হার সেই অনুপাতে বাড়েনি। উপরন্তু রয়েছে সামাজিক বৈষম্যের জের। অক্সফ্যাম ইন্ডিয়া থেকে প্রকাশিত ইন্ডিয়া ডিসক্রিমিনেশন রিপোর্ট ২০২২-এ বলা হয়েছিল যে, ভারতে মহিলারা শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কাজের অভিজ্ঞতার নিরিখে পুরুষদের সমান হলেও বৈষম্যের শিকার হন। যার নেপথ্যে কখনও থাকে নিয়োগকারীর পক্ষপাত, কখনও সমাজে চলা আসা নারীর প্রতি অবহেলা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সম্প্রতি সে ছবিটা বদলাচ্ছে। নিয়োগকারীর তোয়াক্কা না করে নিজেরাই আর্থিক উপার্জনের পথ খুঁজে নিচ্ছেন অনেক মহিলা। ২০১৮ সালের জুন মাস থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর, এই সময়ের মধ্যে দেশের মহিলাদের মধ্যে স্বনির্ভরতার পরিমাণ বেড়েছে ১৪ শতাংশ। আর সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, কর্মরতা মহিলাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই অন্ত্রপ্রনর। অর্থাৎ, কোনও বাঁধাধরা চাকরির বদলে তাঁরা নিজেরাই কোনোভাবে উপার্জন করতে শুরু করেছেন।
আরও শুনুন: লোকে কী ভাববে! আর ভাবছেন না ভারতীয় মহিলারা, সিঙ্গল থেকেই খুঁজে নিচ্ছেন সুখ
আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। এর আগে দেশের জিডিপি কমে যাওয়ার আবহে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া দাবি করেছিল, দেশের মেয়েদের এই অবৈতনিক গার্হস্থ্য শ্রমের যদি আর্থিক মূল্য হিসেব করা হয়, তবে তার পরিমাণ দাঁড়াবে দেশের মোট জিডিপি-র সাড়ে সাত শতাংশ। কর্মক্ষেত্র বলে স্বীকৃত যে বাইরের দুনিয়া, অর্থাৎ যেখানে কাজের প্রেক্ষিতে পারিশ্রমিকের অঙ্ক নির্ধারণ করা হয়, মেয়েদের একটা বড় সংখ্যা সেই গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নন বলেই দেশের অর্থনীতির হিসেবে তাঁদের অবদান গ্রাহ্য হয় না। কিন্তু এই সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেল, দেশের শ্রমশক্তির যে পরিসর, সেখানে হঠাৎ করেই একটা বড় উত্থান ঘটেছে মেয়েদের। তাহলে কি মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে? দেশের জিডিপি বেড়েছে? না, তেমন নয়। এই রিপোর্ট জানাচ্ছে, আসলে মেয়েরা কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, কারণ বাজারদরের তুলনায় পরিবারের আয় কমে গিয়েছে। দেশের জিডিপি কমে যাচ্ছে যখন, ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়ছে, বোঝাই যাচ্ছে যে এই সময়ে আগের আয়ের মূল্য আসলে কমে যাচ্ছে। আর সেই ঘাটতি সামাল দেওয়ার জন্যই পেশার জগতে এগিয়ে আসতে হচ্ছে বেশিসংখ্যক মেয়েদের, যেমনটা ঘটেছিল যুদ্ধ কিংবা দেশভাগের বিধ্বস্ত সময়েও। ‘মহানগর’-এর মতো ছবিতে গৃহবধূর চাকরি করতে বাধ্য হওয়ার মধ্যে যে বিষয়টি উঠে এসেছিল। তবে যুদ্ধের সময় মেয়েরা চাকরি খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, কারণ তখনও জনসংখ্যা এখনকার তুলনায় অনেকটা কম। কিন্তু এখন কর্মসংস্থানের পরিসর আরও সঙ্কুচিত হয়েছে। ডিজিটাল যুগে চাকরি তৈরিও হচ্ছে কম। আর সেখানেই দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে নয়া পথ বাছছেন অনেকে। চাকরির বদলে হাঁটছেন নিজের ব্যবসা শুরু করার পথে। তা হয়তো তাঁদের যোগ্যতা কিংবা আশার তুল্যমূল্য হচ্ছে না, কিন্তু পারিবারিক অর্থনীতির বেহাল দশাকে সামলাতে সহায়ক হচ্ছে।
আরও শুনুন: নারীদের গৃহশ্রমের হিসেব ধরলে বাড়ত দেশের জিডিপি, দাবি করল এসবিআই
আসলে পরিবারের আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। আর করোনার সময় তার পালে হাওয়া লাগে। এর আগেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং রয়টার্সের সমীক্ষা বলেছিল, করোনাকালে কর্মরত মহিলাদের উপর অভিঘাত এসেছে অনেক বেশি। কর্মরত পুরুষদের বেকারত্বের হার ১২.৬%, আর মহিলাদের বেকারত্বের হার প্রায় ২০%। এ ছাড়া বেতন হ্রাসের শতকরা হিসাবও পুরুষদের অনুপাতে প্রায় দেড় গুণ। বুঝতে অসুবিধে নেই, এর একটা বড় কারণ ছিল যে মহিলারা অনেকেই কাজ করেন অসংগঠিত শিল্পে, যা সেসময় ব্যাপক ধাক্কা খায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে কী করেছেন এই কাজ হারানো, মাইনে কমে যাওয়া, চাকরি ফিরে না পাওয়া মহিলারা? সেখানে ওই সমীক্ষাই জানিয়েছিল, ৪৩% মহিলা কাজ হারানোর পর শুরু করেছেন নিজের ব্যবসা। মূলত দু’ধরনের ব্যবসা— জামাকাপড় সংক্রান্ত, এবং অ্যাপ তৈরি ও ব্যবহার সংক্রান্ত ব্যবসাতেই ভরসা রেখেছেন নতুন ভাবে পথ চলতে শুরু করা মহিলারা। এই প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলতে হয়, যে, একুশ শতকে অনলাইন প্ল্যাটফর্মের জনপ্রিয়তা বাড়ার দরুন মেয়েদের নিজেদের পথ খোঁজার সুবিধা একটু হলেও বেড়েছে। কোনও পণ্যের প্রোমোশন হোক বা কেনা-বেচা, চোখ বন্ধ করে এখন অধিকাংশ মানুষের ভরসা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বহু মহিলার কাছে আত্মনির্ভর হয়ে ওঠার অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম এই অনলাইন সেলিং।
গোটা দেশ জুড়েই বেকারত্বের সমস্যা যেভাবে বাড়ছে, তা সকলেরই জানা। সেখানে মেয়েরা টিকে থাকার নয়া উপায় খুঁজতে চাইছেন, সেই চেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। কিন্তু মেয়েরা কী কাজ করবেন, কীভাবে কাজ করবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার যেন তাঁদের থাকে, সেদিকটিতেও নজর রাখা জরুরি। সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হওয়ার আবহে তাই সেই প্রশ্নও জারি থাকুক।