ধর্ম আমাদের ধারণ করে। জীবনের এই শাশ্বত সত্য বহুকাল থেকে আমরা জেনে এসেছি। কেমন সেই ধারণ প্রক্রিয়া? ধর্মকে অনুসরণ করে কীভাবে কেউ হয়ে উঠতে পারেন প্রকৃত ধার্মিক? শোনাচ্ছেন, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।
আমাদের জীবন পদ্মপত্রে জলবিন্দু। অনেক সাধনা করে তবেই নাকি পাওয়া যায় এই মানবজীবন। এমন মানবজনম আর কী হবে, মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে… হ্যাঁ, চিরকাল ধরে এই সত্য আমরা জেনে এসেছি।
কিন্তু কেনই বা মানুষের জীবন এত দুর্লভ?
এর উত্তরে বলা যায়, একমাত্র মানুষই পারে, ধর্ম উপলব্ধি করে জীবনের সার্থকতা স্পর্শ করতে।
তাহলে, কী করে আমরা জানব ধর্মকে? কাকে আমরা বলব ধার্মিক?
শাস্ত্রে বলে,
সর্বেষাং যঃ সুহৃন্নিত্যং সর্বেষাং চ হিতে রতঃ।
কায়েন মনসা বাচা স ধর্মং বেদ জাঞ্জলে।।
অর্থাৎ, যিনি কিনা কায়মনোবাক্যে সকলের হিতে রত থাকেন, তিনিই অনুধাবন করেছেন প্রকৃত ধর্মকে। হিন্দুধর্মের শাস্ত্রসমূহ অগাধ জ্ঞানের রাশি। এই শাস্ত্রের আধারেই যুগ যুগ ধরে ঋষিরা তাঁদের সাধনালব্ধ জ্ঞান আমাদের জন্য অকাতরে বিলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। সেগুলোর অর্থ উপলব্ধি করতে পারলেই আমরা হয়ে উঠতে পারি প্রকৃত ধার্মিক। আমাদের এলোমেলো জীবনকে তাই সঠিক পথে চালনা করতে পারে শাস্ত্রের যথাযথ জ্ঞান।
শ্রীগীতায় উল্লেখ আছে, জগৎ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই প্রজাপতি সৃষ্টি করেছেন যজ্ঞ। যজ্ঞ বলতে আমরা সচরাচর যেমন যাগযজ্ঞ বুঝে থাকি, শুধুমাত্র তা কিন্তু নয়। বরং এই যজ্ঞের মধ্যেই আছে পারস্পরিক আদানপ্রদানের সূত্র। একের জন্য অন্যের ত্যাগ স্বীকারের মহৎ নির্দেশিকা। সেই নিরিখেই তৈরি হয়েছে নানাবিধ কর্মকাণ্ডের বিধিবিধান। তাই বলা যায়, যজ্ঞই ধরে রেখেছে এই জগৎকে। মহাভারতে শুনি সেই কথারই প্রতিধ্বনি, অনুযজ্ঞং জগৎ সর্বং যজ্ঞশ্চানুজগৎ সদা।
মানুষের এই পুরো জীবন তাই যেন যজ্ঞেরই এক রূপ।
এখন আমাদের বুঝতে হবে, শাস্ত্রকাররা যে যজ্ঞের কথা বলছেন, তা আসলে কেমন? শাস্ত্রে আছে হিন্দুদের জন্য নির্ধারিত পালনীয় পাঁচ মহাযজ্ঞের বিধান। এক এক করে আমরা তা জেনে নিলে দেখব, এ শুধু কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের পালনীয় বিধি নয়। সমগ্র মানবতার স্বার্থেই যেন নির্দিষ্ট হয়েছে এই বিধান। হিন্দু ধর্ম এবং শাস্ত্রের যে উদারতা এবং বিশ্বপ্রেম- তাই-ই যেন ধরা পড়ে এইসব বিধানে।
প্রথম যজ্ঞ, ঋষিযজ্ঞ বা ব্রহ্মযজ্ঞ। এই যজ্ঞে আমাদের কর্তব্য অধ্যয়ন ও সন্ধ্যা-বন্দনা। দ্বিতীয় যজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ বা তর্পণ। পিতৃপুরুষের উদ্দেশে তর্পণের কথা আমরা সবাই জানি। তবে, তর্পণ কিন্তু কেবল পিতৃপুরুষের জন্য সীমায়িত নয়, বরং এর অর্থ আরও ব্যাপক। যাতে অন্যের তৃপ্তি হয়, সেই উদ্দেশে জলদান – এই হল তর্পণের অর্থ। তর্পণ তাই সকলের জন্যই প্রযোজ্য। সর্বভূতের উদ্দেশ্যেই জলদান করে তাই বলতে হয়, দেবগণ ঋষিগণ, পিতৃগণ, নরগণ সকলেই যেন আমার দেওয়া জলে তৃপ্তি লাভ করেন।
আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্তং দেবর্ষি পিতৃমানবাঃ।।
তৃপন্ত্য পিতরঃ সর্বে মাতৃমাতামহোদয়ঃ।।
আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তং জগৎ তৃপ্যতু।
অর্থাৎ, ব্রহ্মা থেকে তৃণ- সকলেই তৃপ্তি লাভ করুন। এই হল আমাদের প্রকৃত তর্পণ।
ফিরে আসি যজ্ঞের কথায়। তৃতীয় যজ্ঞ হল, দৈবযজ্ঞ বা হোম ইত্যাদি, চতুর্থ যজ্ঞের নাম নৃযজ্ঞ – অর্থাৎ অনাথ কিংবা অতিথিকে অন্নদান। তবে এখানেই শেষ নয়, আছে আরো-একটি যজ্ঞের কথা। এই পঞ্চম যজ্ঞ অর্থাৎ ভূতযজ্ঞে বলা হচ্ছে পশুপক্ষীকেও অন্নদান। শাস্ত্র বলেন, অন্যকে অন্নদান না করে যদি কেউ অন্নগ্রহণ করে, তবে সে আসলে পাপই ভক্ষণ করছে। কেননা সে তার ধর্ম পালন করছে না। এই যজ্ঞ সম্পাদন করছে না। যে যজ্ঞ বলছে, অনাথ, অতিথি থেকে শুরু করে পশুপক্ষীকে পর্যন্ত অন্নদান আমাদের নিত্যকর্তব্য। সেই যজ্ঞের পরে নিজের জন্য যা অবশিষ্ট থাকে তাই আমাদের প্রাপ্য। আমাদের শাস্ত্রকাররা তাই এর নাম দিয়েছেন অমৃত। হ্যাঁ, অমৃত কোনও অলীক বস্তু নয়। সকলের তৃপ্তিসাধনের পর নিজের প্রাপ্যটুকুর ভিতর যে অনির্বচনীয় আনন্দবোধ, তাই-ই অমৃত।
ধর্ম আমাদের এই শিক্ষাই দেয়। এইভাবে আমাদের ছন্নছাড়া জীবনকে বেঁধে দেয় পরোপকারের সুতোয়। ধর্মপালন মানে তাই শুধু মন্ত্রোচ্চারণ কিংবা অঞ্জলি দেওয়া নয়। বরং এই পালনীয় আচরণবিধির গূঢ় কথাটুকু আরও ব্যাপক, আরও বৃহৎ। যে পঞ্চযজ্ঞের কথা শোনা গেল, সেগুলো তো আসলে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের নাড়ির যোগ সাধনের কথাই বলে। যে সমাজ মানুষ-পশুপক্ষী-বৃক্ষ তৃণ – সবকিছু নিয়ে বিরাট একটা সংসার। সংসারে কেউ খাটো নয়, কেউ পর নয়। সকলের জন্যই আমার কিছু কর্তব্য আছে। সকলেরও কিছু কর্তব্য আছে আমার প্রতি। এইভাবেই ধর্ম আমাদের ধারণ করে। আমরা উপলব্ধি করি এ জগৎ ব্রহ্মময় – সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম। এই উপলব্ধি, এই অধ্যাত্ম সত্যের উপরই প্রতিষ্ঠিত আমাদের সমাজ জীবন। আমাদের ধর্মশাস্ত্র যেন নিয়ত আমাদের শিখিয়ে দেয়, নিজেকে নিয়ে বিব্রত থাকা আমাদের কাজ নয়, সকলের তরে সকলে আমরা। এই গূঢ় সত্যটুকু যিনি অনুধাবন করতে পারেন তিনিই প্রকৃত ধার্মিক।